আমরা রামায়ণে সীতার কথা সকলেই শুনেছি বা জেনেছি, পতির
ভাগ্যকে নিজ ভাগ্যরূপে মেনে নিয়ে তিনিও বনবাসে গিয়েছিলেন। তাঁর এই ত্যাগ আধুনিক
যুগেও কি সমান ভাবে গ্রহণযোগ্য? পরমানন্দ মিশনের “চরৈবেতি” তে প্রকাশ করেছিলেন
শ্রীচন্দ্রকিশোর তানেজা মহাশয়। তাঁর প্রবন্ধের নাম দিয়েছিলেন “ধরিত্রী কন্যা সীতা”
। পুরোটা পরার পর তোমাদের সাথে শেয়ার না
করে পারলাম না। এসো আমরা তা দেখে নিই।
ধরিত্রী কন্যা সীতা
লেখকঃ – চন্দ্রকিশোর তানেজা
মূকং করোতি বাচালাং পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম্।
যতকৃপা তমহং বন্দে পরমানন্দমাধবম্।।
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ভারতের নারীর আদর্শ সীতা,
সাবিত্রী, দময়ন্তী। বাস্তবিক সীতা সর্বকালের সর্বদেশের নারীর আদর্শ। সীতার
পাতিব্রত অতুলনীয়, তাঁর সহিষ্ণুতা পৃথিবীতুল্য, পবিত্রতা পুস্পতুল্য, স্নেহে তিনি
মাতৃতুল্য, চারিত্রিক দৃঢ়তায় বজ্রতুল্য। এই অযোনিসম্ভবা, অপাপবিদ্ধা, সর্বংসহা,
তপ্তকাঞ্চনবর্ণা, মুগ্ধস্বভাবা নারী সারা বিশ্বের মাতৃস্বরূপা। সেই মাতৃচরণ বন্দনা
করে তাঁর চরিত্র বর্ণনা করতে প্রয়াসী হয়েছি। হরধনু ভঙ্গের পর রাজা জনক যখন রামকে
সীতার যোগ্য পাত্ররূপে বিবেচনা করে মহর্ষি বিশ্বামিত্রকে নিজ অভিপ্রায় ব্যক্ত
করলেন, তখন তিনি সীতার পরিচয়ও কথা প্রসঙ্গে প্রকাশ করলেন। রাজর্ষি জনক জানালেন,
সীতা তাঁর পত্নীর গর্ভজাত নয়, ইনি পৃথিবীজাত – যজ্ঞভূমি কর্ষণের সময় লাঙ্গলের মুখে
মাটি ভেদ করে ইনি উঠেছিলেন। ইনি অযোনিসম্ভবা, পৃথিবীই এই কন্যার মা।
বিবাহকালে রাজর্ষি তাঁর ষষ্ঠবর্ষীয়া সর্বালঙ্কার ভূষিতা
সীতাকে অগ্নিসমক্ষে ত্রয়োদশবর্ষীয় রামের কাছে এনে বললেনঃ
“ইয়ং সীতা মম সুতা সহধর্মচরী তব।” বিবাহ মণ্ডপেই রাজর্ষি
জনক সীতাকে মহাভাগ্যবতী বলে উল্লেখ করে রামকে বললেন, এই আমার কন্যা সীতা। একে
গ্রহণ করো। এই বলে রাজর্ষি ভবিষ্যদবাণী করলেন, ‘আমার মেয়ে বলে বলছি না। ইনি সত্যিই
অপাপবিদ্ধ, পবিত্র, একে গ্রহণ করে তুমি সুখী হবে। কেননা, ইনি হবেন পতিব্রতা এবং
ছায়ার মত তোমার অনুসরণ করবেন।’ রাজর্ষির ভবিষ্যদবাণী যে অক্ষরে অক্ষরে ফলেছিল
রামায়ণের পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে তা ক্রমশ পরিস্ফুট হয়েছে।
যাইহোক, বিবাহান্তে রাজর্ষি প্রচুর উপঢৌকন (যাকে তখনকার
দিনে কন্যাধন বলা হত) কন্যাকে শ্বশুরালয়ে পাঠিয়ে দিলেন। শ্বশুরবাড়িতে এসে সীতা
রামের সঙ্গে সুখে কাল কাটাতে লাগলেন। বারো বছর পর এ সুখের চরমমুহূর্তে এসে তাল
কেটে গেল। বার্ধক্যহেতু রাজা দশরথ চিন্তা করলেনঃ “প্রীতিরেষা কথং রামো রাজা
স্যান্ময়ি জীবিতে” – আমি বেঁচে থাকতে থাকতে রামকে যদি রাজপদে অভিষিক্ত করা যায়,
তাহলে আমার পূর্ণ তৃপ্তি হয়। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। দশরথ রাজপুরোহিত বশিষ্ঠ ও
বামদেবকে বললেনঃ
“চৈত্রঃ শ্রীমানয়ং মাসঃ পুণ্যঃ পুষ্পিতকাননঃ।
যৌবরাজায় রামস্য সর্বমেবোপকল্ল্যতাম।।”
এখন সুন্দর চৈত্রমাস। বন-উপবন পুষ্পলতায় যেন হেসে উঠেছে। এই
শুভ সময়ে শ্রীরামচন্দ্রের রাজপদে অভিষেকের আয়োজন করুন।
কিন্তু রাজা দশরথের পরিকল্পনা ব্যর্থ হোল কেন সে গল্প
আমাদের সকলের জানা। মন্থরার কুপরামর্শে, কৈকেয়ীর কূটকৌশলে রামের বনবাস হোল চৌদ্দবছরের
জন্য। কিন্তু সীতা? কৈকেয়ী তো রামের বনবাস চেয়েছিলেন, সীতার তো নয়। সীতা কেন বনে
গেলেন? এ প্রশ্নের উদয় অনেকের মমনেই হয়।
রামায়ণে দেখা যায়, পুরুষোত্তম রাম পিতার আদেশ স্থির চিত্তে
শুনলেন এবং বিনাবাক্য ব্যয়ে বনবাসের জন্য প্রস্তুত হয়ে সহধর্মিণী সীতার সাথে দেখা
করতে গেলেন। সীতা তখনো এই নিষ্ঠুর পিত্রাদেশের কথা জানতেন না। তিনি অতি প্রসন্ন
ছিলেন এই ভেবে যে, আজ তাঁর প্রিয়তম পতির যৌবরাজ্যে অভিষেক হবে। তাই তিনি পতির
কল্যাণ কামনায় দেবতাদের পুজো দিয়ে অত্যন্ত ঔৎসুক্য সহকারে শ্রীরামের প্রতীক্ষা
করছিলেন। কিন্তু রাম এসে বিপরীত বার্তা শোনালেন, “অহং গমিষ্যামি মহাবনং প্রিয়ে।
ত্বয়াহিবস্তব্যমিহৈব ভাসিনি।” – আমি বাবার নির্দেশে ঘোরবনে যাব – একথা বলে সীতাকে
দীর্ঘ উপদেশ দিলেন, যার মূল বক্তব্য হলঃ – রামের বনবাসকালে সীতা যেন অযোধ্যার
রাজপুরীতেই থেকে যথাযথ কর্তব্য পালন করে সকলকে তুষ্ট করেন। রামের এই কথা শুনে
প্রণয়কুপিতা সীতা বললেন, আমি খুব খারাপ- তোমার অযোগ্য। তাই তুমি এমন কথা বলতে
পারলে। তোমার কথা শুনে আমার হাসি পাচ্ছে। যে আর্যপুত্র! তুমি তো জান, বাবা, মা,
ভাই, পুত্র এবং পুত্রবধূ – এরা সকলেই আপন কর্মানুসারে ফলভোগ করে। কিন্তু
“ভর্ত্তুর্ভাগ্যং তু নার্যেকা প্রাপ্নেতি পুরুর্ষভ।” – ‘একমাত্র নারীই স্বামীর
ভাগ্যের অনুগামী হয়। অতএব তোমার বনবাসের আদেশের সঙ্গে আমিও বনবাসের জন্য আদিষ্ট
হয়েছি।’ এর পর সীতা তাঁর দৃঢ়মত ব্যক্ত করলেনঃ ‘যদি আজই তুমি বনে যাও, তা হলে
কাঁটাকুশ মাড়িয়ে আমি তোমার আগে আগে যাব।’
সুতরাং আমাদের প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল। সীতা বনগমনে
আদিষ্ট না হয়েও একান্ত পতিগতপ্রাণা বলে পতির ভাগ্যকেই নিজভাগ্য বলে মেনে নিয়ে
স্বেচ্ছায় বনবাসী হয়েছিলেন।
কিন্তু আধুনিক কালের অনেকেই প্রশ্ন করেন, এত ভালো কি ভালো?
এত পাতিব্রত এও কি সম্ভব? বিশেষ করে এই একবিংশ শতাব্দীতে? তাদের বক্তব্য, এ যুগ
নারী স্বাধীনতার যুগ। এ যুগ এগিয়ে চলার যুগ। এ যুগ বিজ্ঞানের যুগ। এখন নারীপুরুষের
কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমানতালে চলার যুগ। এ যুগের নারী রকেটে চড়ে চাঁদে যাচ্ছে, আকাশে
উড়োজাহাজ চালাচ্ছে, ডুবোজাহাজে চড়ে সমুদ্রের গভীরে চলে যাচ্ছে। তাই এ যুগ
প্যানপ্যানানির যুগ নয় – এ যুগের নারী পুরুষের সাথে সমানতালে তাল ঠুকে চলে।
তবে এ যুগের নারী সীতাকে আদর্শ মনে করবে কেন? সত্যিই সীতাকে
আদর্শ মনে করা যায় কি না, একটু তলিয়ে দেখা যাক।
প্রথমে স্বাধীনতার কথা ধরা যাক। সীতারও স্বাধীনতা ছিল। আমরা
আগেই দেখেছি, সীতাকে কেউ বনে পাঠায়নি। এমন কি, স্বয়ং রামও বনবাসের কষ্ট বুঝিয়ে
সীতাকে বনে নিয়ে যেতে চাননি। কিন্তু রামের গভীর প্রণয়বশত তাঁর থেকে বিচ্ছেদ চাননি।
তাই স্বেচ্ছায় বনবাসী হয়েছিলেন। এখানে স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে বা লঙ্ঘিত হয়েছে,
একথা বলা যায় না। এ যুগের স্বাধীন নারীর মতই তিনি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রামের অনুগামী
হয়েছেন। এবার আর একটা প্রশ্ন ওঠে, সীতার পতিভক্তি বাড়াবাড়ি নয় কি? রাজার মেয়ে,
বিখ্যাত রাজার ঘরের বউ – হুট করে বনে চলে গেলেন! তাও আবার মধুচন্দ্রিমা যাপন নয়,
একেবারে চৌদ্দবছরের জন্য। একি পাগলামি নয়?
হ্যাঁ, আমাদের আধুনিক যুগের মানুষের মতে এ পাগলামি ছাড়া আর
কিছু নয়। কিন্তু ভারতীয় ঋষিরা এ পাগলামিই চেয়েছিলেন। সীতার ঐ পাগলামিকে সামনে রেখে
চলার জন্যই ভারতীয় সমাজবন্ধন আজো দৃঢ়। এ যুগেই রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসী স্বামী
লোকেশ্বরানন্দ রাশিয়া থেকে ফিরে এসে বলেছিলেন, রাশিয়ানরা ভারতীয়দের দাম্পত্যবন্ধন
দেখে মুগ্ধ। রাশিয়ার তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান মন্তব্য করেছিলেন, ‘I wonder how you spend your whole life with a
single wife’. অর্থাৎ
আপনারা সারাজীবন একটিমাত্র স্ত্রী নিয়ে কিভাবে কাটান ভেবে আমি অবাক হই।
যাইহোক, আধুনিকারা বলবেন, ভরা যৌবনে (স্মরণার্থে নিবেদনঃ
সীতা যখন বনে যান তখন তিনি অষ্টাদশী) সীতার মত বনে গিয়ে বাস! অসম্ভব। বরং ঐ রকম
রামকে পত্রপাঠ বিদায় দিয়ে যৌবনের আনন্দ ভোগ করব। কিন্তু তো দেখা যায়, ডিভোর্সের
পরেও স্বাধীনভাবে যৌবনে সম্ভোগের আনন্দ মিলল না। তখন কি হবে? তখন কি আবার? এভাবে
সুখের আশায় মরীচিকার পেছনে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত শ্রান্ত বিরক্ত হতে হতে বাঁচার
আশাই ফুরিয়ে যায়। তাই আমাদের ঋষিদের বিধান, বিবাহবন্ধন অচ্ছেদ্য।
স্বামী লোকেশ্বরানন্দের কথা থেকে এটা প্রমান হয় যে, এই
আধুনিক যুগেও, দে দেশে ডিভোর্স জলভাত, সেই দেশের প্রথম সারির লোকেরাও ভারতীয় দৃঢ়
দাম্পত্য জীবনের আদর্শকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে দেখেছেন।
যাইহোকম বর্তমান একবিংশ শতাব্দীর প্রেক্ষিতে অনাদিষ্ট হয়েও
সীতার বিপৎসঙ্কুল বনে রামের অনুগমন করার যৌক্তিকতা নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা করা গেল।
পূর্বপ্রসঙ্গে ফিরে যাই। ধর্মজ্ঞ রাম সীতার ইচ্ছা জেনেও
বনবাসের কষ্টের কথা বর্ণনা করে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলেন না। তিনি সীতাকে
সান্ত্বনা দেওয়ার ছলে বললেন, তুমি এখানে থেকেই ধর্মাচরণ কর, তাতেই আমি সুখী হব।
এরপর রাম বনবাসের দুঃসহ কষ্টের কথা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করে সীতাকে ঐ কষ্টদায়ক
বনবাস থেকে নিবৃত্ত হতে অনুরোধ করলেন। রাম বললেনঃ
“সীতে বিমুচ্যতামেষা বনবাসকৃতি মতিঃ।
বহু দোষা হি কান্তারং বনমিত্যভিধীয়তে।।” – অযোধ্যাকাণ্ডে ২৮
সর্গ/ ৫
শোন, সীতা! বনবাসের চিন্তা ছেড়ে দাও, বনবাসের বহু দুঃখ।
সীতা রামের একথায় গভীরভাবে ব্যাথিত হয়ে অশ্রুভেজা চোখে বললেনঃ ‘তুমি বনবাসের যে
দুঃখের কথা শোনালে, সে সব দুঃখ তোমার স্নেহসঙ্গে সুখে পরিণত হবে। তুমি সঙ্গে থাকলে
সবরকম হিংস্র জন্তু দূরে পালিয়ে যাবে, কেননা, তোমাকে সবাই ভয় পায়।’ বহু চেষ্টা
করেও রাম সীতাকে বনগমন থেকে নিবৃত্ত করতে পারলেন না। সীতার নিখাদ প্রেমের কাছে রাম
পরাস্ত হলেন। অবশেষে বললেন, “ন দেবি তব দুঃখেন স্বর্গমপ্যভিরোচয়ে” – হে দেবি,
তোমাকে এই বেদনার্ত অবস্থায় ফেলে রেখে স্বর্গসুখও আমি চাই না। অতএব চলো আমার
সঙ্গে। মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হওয়ায় সীতা প্রফুল্ল মনে পতির নির্দেশে তাঁর সমস্ত দামী
বস্ত্র-অলঙ্কার ব্রাহ্মণদের দান করে, ভিক্ষুকদের পরিতৃপ্তি সহকারে ভোজন করালেন।
এবার সীতা ও লক্ষণ সহ শ্রীরামচন্দ্রের বনবাসের যাত্রার
পালা। সীতা রাজদুহিতা, রাজকুলবধূ, গায়ের রং তাঁর গলানো সোনাকে হার মানায়। সুন্দর
বসন-ভূষণে সেজে থাকলেই তাঁকে ভালো লাগে। এভাবেই লোকে তাঁকে দেখতে অভ্যস্ত। আজ সেই
অনিন্দসুন্দরী দেবী প্রতিমা রাজপুরী হতে বিসর্জিত হতে চলেছেন। সমগ্র রাজপুরী
বেদনায় বিহ্বল। সকলের চোখ অশ্রু ছলছল। সখী-দাসী-ঘেরাজীবনে অভ্যস্ত এই রাজপুর নারী
নিজের বস্ত্র নিজে পরতেও জানেন না। নিতান্ত মুগ্ধস্বভাবা সীতা সারল্যে
দেবশিশুতুল্যা। সেই সীতাকে নিতান্ত নিষ্ঠুর রমণী কৈকেয়ী বল্কল ধরিয়ে দিলেন। সীতা
বল্কল (গাছের ছাল) -এর এক খণ্ড কাঁধের ওপর ফেলে ওপর খণ্ড হাতে ধরে লজ্জা রাঙা মুখে
পতির পানে চেয়ে রইলেন। রাম তাড়াতাড়ি এসে সীতার সোনার অঙ্গে জড়ানো রেশমী শাড়ির ওপর
বল্কল বেঁধে দিলেন। তা দেখে রাজবাড়ির মেয়েদের চোখের জল অবিরল ধারায় ঝড়ে পড়তে লাগল।
তাঁরা সমস্বরে বলতে লাগলেন, ‘হে রাম! তুমি পিতৃসত্য পালনের জন্য যতদিন দূরে থাকবে,
ততদিন মা সীতা এখানে থাকুন – তোমার অদর্শনকালে তোমার প্রতিভূ এই মাকে দর্শন করে
আমাদের জীবন সফল করার অনুমতি দাও।’ সীতা যে কতখানি জনপ্রিয় বা প্রিয়দর্শিনী, তা
অন্তঃপুরিকাগণের এই আবেদন থেকেই স্পষ্ট।
সীতা ইতিমধ্যে বল্কল ধারন করেছেন। তা দেখে রাজকুলগুরু
বশিষ্ট কৈকেয়ীকে তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনা করে বললেন, ‘দেবী সীতা বনে যাবেন না। বরং
রামের জন্য নির্দিষ্ট সিংহাসনে ইনিই বসবেন। কারণ, ইনি রামের আত্মা। রামের
অনুপস্থিতিতে ইনিই রামের প্রতিনিধিত্ব করার শাস্ত্রসম্মত অধিকারিণী।’
এরপর রাজগুরু যা বললেন, তা সীতার সর্বজনপ্রিয়তার এক অনন্য
নিদর্শন। রাজগুরু বললেন, “অথ যাস্যতি বৈদেহী বনং রামেণ সঙ্গতা। বরমত্রানুযাস্যামঃ
পুরং চেদং গমিষ্যতি।।” – এরপর সীতা যদি রামের সাথে বনে যান, তাহলে আমরাও সমগ্র
অযোধ্যানগরীকে নিয়ে বনে যাব। - অযোধ্যাকাণ্ডে ৩৭ তম সর্গে ২৫ সংখ্যক শ্লোক।
সাধ্ববী সুকোমলা সীতার প্রতি স্নেহস্নিগ্ধ মুনি এবার
কৈকেয়ীর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘হে কৈকেয়ী! তোমার প্রার্থিত বরানুসারে রামেরই বনবাস
নির্দিষ্ট। কিন্তু সীতা যদি রামের অনুগমন করেন, তাঁর স্বেচ্ছাবৃত্তি থেকে করবেন।
তাঁর বনগমনের সাথে কাঙ্ক্ষিত বরের কোন সম্পর্ক নেই। অতএব বনে গমন করুন রাজকীয়
মর্যাদায়, উপযুক্ত বস্ত্র অলঙ্কারে বিভূষিত হয়ে।’
সীতা কিন্তু তাঁর প্রিয়তম পতির অনুরূপ বল্কল ধারন করা থেকে
বিরত হলেন না।
সীতা চরিত্রের তিনটি বৈশিষ্ট্য মহর্ষি বাল্মীকি আমাদের চোখে
আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন।
(১) সীতার একান্ত পতিনিষ্ঠা। (২) বসন-ভূষণে নির্মোহতা, যা
তাঁর ঐকান্তিক পতিপ্রেমেরই প্রকাশ। (৩) তাঁর নির্লোভতা। রাজগুরু বশিষ্টদেব তাঁকে
রামের পরিবর্তে সিংহাসনে বসার অধিকারিণী ঘোষণা করলেও তিনি নিঃস্পৃহ থেকেছেন। এর
মূলেও আছে তাঁর পতিপ্রেম।
তাঁর একান্ত পতিপরায়ণতা মনের অন্যসব বৃতিগুলিকে একমুখী করে
তুলেছে। রামের আসন্ন বিচ্ছেদ আশঙ্কায় তাঁর অন্তরের প্রধান বৃত্তিগুলি, যথা লোভ,
ভয়, মোহ, ইত্যাদি অভিভূত। অতএব, সীতা রামের সঙ্গে বনেই গেলেন। বনের নানা পথ, নদী,
পর্বত অতিক্রম করে তাঁরা অত্রিমুনির আশ্রমে উপস্থিত হলেন।
শ্রীরামের নির্দেশে সীতা অত্রিমুনির বৃদ্ধা তপস্বিনী পত্নী
অনুসূয়াকে প্রণাম করলেন। সীতার প্রণাম গ্রহণের পর অনুসূয়া বললেন, ‘হে দেবি
সৌভাগ্যবশত তুমি ধর্মের প্রতি দৃষ্টি রেখেছে। আত্মীয় বন্ধুদের ছেড়ে, মান প্রতিষ্ঠা
ছেড়ে, তুমি পতির সঙ্গে বনে এসেছ, এ বড় সৌভাগ্যের কথা।’ তিনি আরো বললেন, ‘পতি
স্বেচ্ছাচারী হোক্, সচ্চরিত্র নারীর কাছে তিনি পরম দেবতা। হে বিদেহরাজনন্দিনী!
অনেক ভাবনাচিন্তা করে আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি, স্ত্রীলোকের পক্ষে পতির থেকে বড়
বন্ধু আর কেউ নেই। আবার যে সকল নারী অশুদ্ধচিত্তা ইন্দ্রিয় পরায়ণা, অসংযমী, তারা
পতির ওপর কর্তৃত্ব করে, তাদের সদসৎ বিবেকবোধ না থাকায় স্বৈরাচারী হয়ে সমাজকে
কলঙ্কিত করে। ফলে তারা নিজ কর্মফলে অপযশই ভোগ করে।’
আর তোমার মত সচ্চরিত্রা নারী পুণ্যকর্মের ফলে স্বর্গসুখ ভোগ
করে। অতএব তুমি তোমার স্বামীর সেবায় লেগে থেকে সর্বদা তাঁর গুন অনুসরণ করো
তপস্বিনী অনুসূয়ার সীতার উদ্দেশ্যে উচ্চারিত বাক্যগুলি একপ্রকার অনুশাসন। সাধ্বী
সীতা সসম্মানে ঐ অনুশাসন সমর্থন করলেন এবং তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করলেন।
বর্তমানে আমাদের মা-বোনেরা ঐ অনুশাসন বাক্যগুলি মেনে চললেই
সমাজের মঙ্গল। সীতাকে উপলক্ষ করে অনুসূয়া নারীজাতির সম্মুখে একটি আদর্শ স্থাপন
করতে চেয়েছেন। আদর্শের হুবহু অনুসরণ সব সময় সম্ভব হয় না। তার যতটুকু জীবনে
বাস্তবায়িত করা যায় ততটুকুই মঙ্গল। কথাপ্রসঙ্গে তাপসী অনুসূয়া সীতার
বিবাহবৃত্তান্ত শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করলে সীতা তাঁর জন্মকাল থেকে বিবাহকাল পর্যন্ত
সমস্ত ঘটনা সবিস্তারে তাপসীকে জানালেন। তিনি জানালেনঃ ‘মাঠে কাজ করার সময় ধুলোমাখা
অবস্থায় আমাকে পেয়ে নিঃসন্তান রাজর্ষি জনক আমাকে বুকে তুলে নিয়ে বলেছিলেন, ‘এ আমার
মেয়ে।’ সেই সময় আকাশবাণী হলঃ ‘সত্যিই রাজা এই শিশু তোমারি কন্যা।’ এইভাবে রাজা জনক
আমার পিতা। রাজপরিবারে সুখৈশ্বর্যের মধ্যে বড় হতে হতে বিয়ের বয়স হলে রাজর্ষি আমার
জন্য স্বয়ম্বরের ব্যবস্থা করলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, তাঁকে দেওয়া বরুণদেবের ধনুকে
জ্যা পরাতে পারবে যে বীর, আমার এই কন্যা তাঁরই পত্নী হবে। ঋষি বিশ্বামিত্রের সঙ্গে
এসে দাশরথি রামচন্দ্র ঐ ধনুকে জ্যা পরিয়ে দিলে রাজর্ষি তাঁর হাতে আমাকে সমর্পণ
করেন। সেই থেকে আমি বীরশ্রেষ্ঠ রামের অনুরাগিণী।’
ইতিমধ্যে আমরা সীতার পাতিব্রত, সহনশীলতা, ত্যাগ, বৈরাগ্য
ইত্যাদি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পেয়েছি। তাঁর চরিত্রের আরো এক বিশিষ্টতা হল
তাঁর অহিংসা, দয়া ও জীবপ্রেম।
অত্রিমুনির আশ্রম ছেড়ে সীতা সহ রাম-লক্ষণ শরভঙ্গ ও
সুতীক্ষ্ণ মুনির আশ্রম হয়ে দণ্ডক বনে প্রবেশ করলেন। এই দণ্ডক বনে সীতা চরিত্রের আর
একটি দিক উন্মোচিত হল। এই বনে এসে সীতা রামকে বললেন, ‘তুমি ধর্মজ্ঞ, তথাপি
সূক্ষ্মভাবে বিচার করে দেখ, তুমি অধর্মাচরণ করছ। মানুষের তিন প্রকারের ব্যসন দেখা
যায়, যথা, মিথ্যা বলা, পরস্ত্রীগমন এবং অকারণে প্রানী হিংসা করা। প্রথম দুটো দোষ
তো তোমার মধ্যে কল্পনাই করা যায় না। কিন্তু তৃতীয় দোষ এখন তোমার সামনে উপস্থিত।’
“তৃতীয়ং যদিদং রৌদ্রং পরপ্রাণাভিহিংসনম্।
নির্বৈরং ক্রিয়তে মোহাৎ তচ্চতে সমুপস্থিতম্।।” অরণ্যকাণ্ডে
৯ম সর্গে ৯ম শ্লোক।
মোহবশত মানুষ এই তৃতীয় দোষে দুষ্ট হয়। তোমার সামনে এখন এই
তৃতীয় দোষের ক্ষেত্র প্রস্তুত। তুমি তো দণ্ডকারণ্যবাসী ঋষিদের রক্ষার জন্য ঐ অরন্যে
বিচরণকারী রাক্ষসদের বধ করবে বলে কথা দিয়েছ। ঐ উদ্দেশ্যে যখনি তুমি দণ্ডক বনের পথে
যাত্রা করেছ, তখনি আমার চিত্ত তোমার মঙ্গল কামনায় চঞ্চল হয়েছে। তাই বলছি,
দণ্ডকারণ্যবাসী রাক্ষসদের বিনা কারণে বধ করো না। আমরা বনবাসে এসেছি তপস্যাপরায়ণ
হয়ে। কিন্তু ক্ষত্রিয়দের নির্মম প্রাণীহিংসা ধর্ম, আর সর্বভূতে দয়ারূপ তপস্যা – এ
দু’য়ে আকাশ পাতাল তফাৎ।
“ক্ক চ শস্ত্রং ক্ক চ বনং ক্ক চ ক্ষাত্রং তপঃ ক্ক চ” – ‘কোথায়
অস্ত্রধারণ, কোথায় বনবাস! কোথায় ক্ষত্রিয়দের নিষ্ঠুর হিংসাময় কর্ম, আর কোথায়
সর্বভূতে দয়ারূপ তপস্যা! এসবই পরস্পর বিরুদ্ধ ধর্ম। আমাদের এখন দেশধর্মের অর্থাৎ
তপোবনোচিত অহিংসা ধর্মের পালন করা উচিত।’ এ পর্যন্ত বলে সীতা পতির অমর্যাদা যাতে
না হয়, সে জন্য বললেন, “সর্বং বিদিতং তুভ্যং” তুমি তো সবই জান। ‘আমি নারীসুলভ
স্বাভাবিক চপলতাবশত ঐ কথাগুলো বললাম। তুমি ছোট ভাই লক্ষণের সাথে আলোচনা করে যা
ভালো বোঝ, তাই কর।’ এই অংশে সীতা যে শুধু রামের ছায়াসঙ্গী নন, তাঁর নিজস্ব মতামতও
তিনি ব্যক্ত করতে পারেন, তার প্রমান পাওয়া যায়। তিনি স্বাধীন মত ব্যক্ত করলেও পতির
মর্যাদা লঙ্ঘন করে স্বমত প্রতিষ্ঠিত করতে চাননি। নিজের মত জানিয়েই তিনি ক্ষান্ত
হয়েছেন। সিদ্ধান্ত রামের ওপরেই ছেড়ে দিয়েছেন। সীতা যে শুধু কোমলস্বভাবা, মুগ্ধা
রমণীই নন, তিনি শাস্ত্রজ্ঞাও, তার পরিচয় এই অংশে ফুটে উঠেছে। এরপর শ্রীরাম, লক্ষণ
ও সীতাকে নিয়ে অগস্ত্যমুনির আশ্রমে উপস্থিত হলে মুনিবর সীতার দিকে দৃষ্টিপাত করে
বললেন,
“এষা চ সুকুমারী চ খেদৈশ্চ বিমানিতা।
প্রাজ্যদৌষং বনং প্রাপ্তা ভর্ত্তৃস্নেহ প্রচোদিতা।।”
‘সুকুমারী এক সীতা জীবনে কখনো দুঃখ দেখেননি। দুর্বার
পতিপ্রেম তাঁকে কষ্টসাধ্য বনে টেনে নিয়ে এসেছে।’ তিনি সাধারণ নারীস্বভাবের বর্ণনা
করে বললেন, ‘এরা সুখের সময় স্বামীর অনুরাগিণী হয়, দুঃখের সময় ত্যাগ করে। কিন্তু হে
রাম! তোমার এই পত্নী সাধারণ নারীর ব্যাতিক্রম। “ইয়ং তু ভবতো ভার্যা দোষৈরেতৈঃ
বিবর্জিতা” – (অরণ্যকাণ্ডে ১৩ম সর্গে ৭ম শ্লোক)। ইনি ঐ সব দোষ থেকে মুক্ত।’
মহর্ষি অগস্ত্যের নির্দেশে শ্রীরামচন্দ্র সীতা ও লক্ষণের
সাথে পঞ্চবটীবনে এসে পর্ণকুটীর নির্মাণ করে বাস করতে লাগলেন। সেখানকার চোখজুড়ানো
প্রাকৃতিক দৃশ্য – নানারকম ফুল-ফলে ভরা গাছগাছালি প্রকৃতিপ্রিয় সীতাকে বিশেষভাবে
মুগ্ধ করল। ছোট্ট নিষ্পাপ বালিকার মত তিনি বনের এদিক ওদিক ঘুড়ে বেড়ান। কখনো
গোদাবরী নদীর পাড়ে বসে নদীর কলকলানি শুনে মুগ্ধ হন। তাঁর একবারও মনে হয়না অযোধ্যার
রাজপ্রাসাদের কথা। সীতার এই সারল্য, এই স্বভাবমুগ্ধতা আমাদের শ্রদ্ধা ও বিস্ময়ের
উদ্রেক করে। আমরা যখন ভাবি বিলাসবৈভবপূর্ণ রাজপ্রাসাদ ছেড়ে ঘোর বনে নিঃসঙ্গ
অবস্থায় কষ্টভোগ করছেন সীতা, তখন এই তাপসীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধায় আমাদের মাথা নত
হয়ে আসে। তাঁর ত্যাগ ও সহিষ্ণুতা আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। স্বামী বিবেকানন্দ ভারতীয়
নারীর আদর্শ ‘সীতা’ বলতে তাঁর এই ত্যাগের মহিমাকেই বিশেষভাবে বুঝিয়েছেন।
পঞ্চবটীবনে অবস্থানকালে সীতার শিশুসুলভ স্বভাবের সুযোগ নিয়েই রাবণ মারীচের
সাহায্যে তাঁকে প্রলুব্ধ করিয়েছিলেন। সীতার অনুরোধে রাম সোনার হরিণের পিছু ধাওয়া
করলে কুটীরে একা লক্ষণই সীতার রখক থেকে যান। কিন্তু সীতাকে রক্ষকশূন্য করার
উদ্দেশ্যে মারীচ রামের কন্ঠ অনুকরণ করে লক্ষণকেও আর্তস্বরে সাহায্যের জন্য ডাকতে
থাকে। রাক্ষসী মায়া বুঝতে পেরে লক্ষণ সীতার পুনঃ পুনঃ অনুরোধ সত্ত্বেও আশ্রম (কুটীর)
ছেড়ে যেতে রাজি না হওয়ায় সীতা তাঁকে অত্যন্ত রূঢ়ভাষায় তিরস্কার করে বলেন,
“ইচ্ছসিত্বং বিনশ্যন্তং রামং লক্ষণ মৎকৃতে।” ‘লক্ষণ, আমাকে পাওয়ার জন্য এখন তুমি
রামের মৃত্যুই কামনা করছ।’ সীতাচরিত্রের এই অংশ নিয়ে অনেক অভিযোগ শোনা যায়। অনেকে
এই অংশে সীতা চরিত্রের ব্যতিক্রম লক্ষ্য করেন। সাধারণভাবে আমরাও তাই মনে করি।
কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যায়, সীতার এই অস্বাভাবিক রূঢ় আচরণের জন্য
রামচন্দ্রের প্রতি গভীর ভালোবাসাই দায়ী। শ্রীরামচন্দ্র বিপন্ন বুঝতে পেরে তিনি আর
স্থির থাকতে পারেননি। সবকিছু বিসর্জন দিয়েও তিনি তাঁর পতির জীবন রক্ষার জন্য
উদগ্রীব হয়ে পড়েছিলেন। হয়তো তাঁর মনে হয়েছিল, লক্ষণকে এভাবে তিরস্কার না করলে তিনি
রামের সাহায্যে অগ্রসর হবেন না।
সীতা কর্তৃক তিরস্কৃত হয়ে শ্রীরামের সাহায্যে যাওয়ার আগে
লক্ষণ সীতাকে বললেন, ‘তোমাকে সমগ্র বনদেবতা রক্ষা করুন। রামের সাথে ফিরে এসে
তোমাকে যেন দেখতে পাই।’ এখতা শুনে সীতা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘লক্ষণ, রামের থেকে
যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই, তাহলে গোদাবরীতে ডুবে মরব, পাহাড়ের ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ব,
গলায় দড়ির ফাঁস লাগাব, তীব্র বিষপান করে অথবা আগুনে প্রবেশ করে জীবন বিসর্জন দেব।
তবু শ্রীরাম ব্যতিত অন্য কোন পুরুষকে স্পর্শ করব না।’
(প্রসঙ্গত মনে রাখা দরকার, বাল্মীকি রামায়ণে লক্ষণগণ্ডির
উল্লেখ নেই।) ঐ বাক্যাবলীর আলোকে লক্ষণের উদ্দেশ্যে উচ্চারিত তিরস্কার-ব্যাঞ্জক
বাক্যগুলি বিচার করা উচিত বলে মনে হয়। তাহলে এই প্রসঙ্গে সীতাকে আর ততখানি অপরাধী
মনে হবে না, যতখানি আমরা মনে করি।
সীতা সারল্যের প্রতিমূর্তি। তাপস বেশধারী দুর্বৃত্ত রাবণকে
দেখে তাঁর মনে কোন সংশয় হল না। তিনি সরল মনে সেই ভণ্ড তাপসকে আহ্বান করলেন। তাঁকে
বসার আসন দিলেন এবং পাদ্য অর্ঘ্য দিয়ে তাঁর যথোচিত সৎকার করলেন। সীতাকে হরণ করতে
ইচ্ছুক রাবণ তাঁর পরিচয় জানতে চাইলে ব্রাহ্মণরূপী অতিথির অভিশাপের ভয়ে সীতা অকপটে
তাঁর পরিচয় সম্পূর্ণরূপে জানিয়ে দিলেন। এই যে তিনি জনমানবশূন্য গভীর অরণ্যে একজন
অচেনা ব্যক্তিকে শুধুমাত্র পোশাক দেখে ঘড়ে বসালেন, তাঁর আপ্যায়ন করলেন, এটা কি
তাঁর বোকামি, না সরলতা, না ভয়? মহর্ষি বাল্মীকির লেখা অনুসারে তিনি
শ্রদ্ধ্যাসহকারেই ব্রাহ্মণের আপ্যায়ন করেছিলেন। তখন ভয়ের কোন প্রশ্ন ছিল না। পরিচয়
জানানোর সময় ছিল ব্রাহ্মণবেশী অতিথির অভিশাপের ভয়, যার মূলে ছিল শ্রদ্ধা ও সরলতা।
রাবণের দ্বারা জিজ্ঞাসিত হয়ে সীতা আত্মপরিচয় দিলেন। কিন্তু
নির্বান্ধব অরণ্যে একজন আগন্তুককে কুটীরে আহ্বান করার আগে তাঁর পরিচয় জানতে চাইলেন
না। এটাই ভারতীয় সনাতন ধর্মের রীতি। অতিথিসেবা গৃহস্থের ধর্ম। ঈশোপনিষদে আচার্যের
অনুশাসনে বলা হয়েছেঃ “অতিথি দেবো ভব” অর্থাৎ অতিথিকে দেবতার মত শ্রদ্ধা করবে।
আগন্তুকের যথাযোগ্য পরিচর্যা না করে তিনি কে, কোথা থেকে এসেছেন ইত্যাদি প্রশ্ন করা
শুধু অশ্রদ্ধারই নয়, অশালীনতারও প্রকাশ। তাই সীতা আগন্তুকের যথোচিত সৎকার করার পর
এবং তাঁর জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পর রাবণের পরিচয় এবং একাকী শ্বাপদসঙ্কুল
বনে বিচরণের কারণ জানতে চাইলেন। এবার রাবণ খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। কোথায় গেল তাঁর
সাধুবেশ, কোথায় গেল তাঁর মধুরবচন! তিনি রূঢ় ভাষায় বললেনঃ “অহং স রাবণো নাম সীতে
রক্ষোগণেশ্বরঃ” – হে সীতে, যার নামে দেবতা, অসুর ও মানুষ ভয়ে থরহরি কাঁপে আমি সেই
রাক্ষসরাজ রাবণ। এই বলে রাবণ সীতার দেহসৌষ্টবের প্রশংসা করতে লাগলেন। আগেও তিনি
সীতার দৈহিক সৌন্দর্যের প্রশংসা করেছিলেন, কিন্তু সাধুবেশের অন্তরালে থাকায় সে
প্রশংসা সীতার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়েছিল, এবার রাবণ সমস্ত অন্তরাল ভেদ করে,
স্বমূর্তি ধারণ করে লম্পটের ভাষায় বললেনঃ
“ত্বাং তু কাঞ্চনবর্ণাভাং দৃষ্ট্বা কৌশেয়বাসিনীম্।
রতিং স্বকেষু দারেষু নাধিগচ্ছাম্যনিন্দিতে।।”
- হে অনিন্দসুন্দরী! সোনার মত তোমার গায়ের রং, তার ওপর
রেশমী শাড়িতে তোমার সৌন্দর্য এমন মনভোলা হয়েছে যে, তোমাকে দেখে আমার আর স্ত্রীগণের
দিকে মন যাচ্ছে না।
এবার রাবণ সীতাকে বহু প্রকারে প্রলোভিত করার চেষ্টা করলেন।
তিনি সীতাকে তাঁর পাটরাণী করার প্রস্তাব দিয়ে বললেন, তাঁর সেবায় পাঁচ হাজার দাসী
নিযুক্ত থাকবে। রাবণের মুখ থেকে একথা শুনে সীতা আহত ফণিনীর ন্যায় গর্জে উঠলেন।
তীব্র ভাষায় তিরস্কার করে বললেন, ‘আমি সিংহের ন্যায় তেজস্বী শ্রীরামচন্দ্রেরই
স্ত্রী। তুই শিয়াল হয়ে কোন দুরাশায় এই দুর্লভ সিংহীকে কামনা করিস?’ (ত্বং
পুনর্জম্বুকঃ সিংহীং মামিচ্ছসি দুর্লভাম্)
এখানে সীতা আর নমনীয় নন, তিনি স্বতেজে দেদীপ্যমান। এতক্ষণ
আমরা যে সীতার পরিচয় পেয়েছি, এ সীতা সে সীতা নন। এতক্ষণ যিনি ছিলেন সত্যতায়,
শালীনতায়, অতিথি পরায়ণতায় মৃদুমধুরভাষিণী এক গৃহিণী, অভিমান ব্যথাহত হয়ে তিনি
ছাইচাপা আগুনের মত দপ্ করে জ্বলে উঠলেন। রাবণের নির্লজ্জ অসম্ভব কামনাকে সীতা
স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণের সঙ্গে তুলনা করে যে সব উপমা দিয়েছেন, তার মধ্যে একটির
উল্লেখ করলেই রাবণের পক্ষে সীতাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা যে নিতান্ত দুরাকাঙ্ক্ষা, তা
যথেষ্ট হবে, যথা “অবসজ্য শিলাং কণ্ঠে সমুদ্রং তর্ত্তুমিচ্ছসি?” (অরণ্য কাণ্ড –
৪৭/৪২) – রে দুর্মতি, তুই গলায় পাথর বেঁধে সমুদ্র পার হতে চাচ্ছিস? রাবণ সীতার কোন
ভর্তসনায় লজ্জা না পেয়ে, তাঁর ধমকানিতে ভয় না পেয়ে অবলীলাক্রমে সীতাকে তাঁর রথে
তুলে নিলেন। সীতা তখন সম্পূর্ণ অসহায়। তাঁর চারিদিকে জনমানব শুন্য। তিনি ছটফট
করছেন আর কাতরভাবে কাঁদছেন। সীতা চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য তাঁর হৃদয়ের প্রসার
এতবেশী যে, তিনি ‘আব্রহ্মস্তম্ব’ সকলকেই তাঁর আপনজন বলে মনে করতেন। লতা-গুল্ম,
পুষ্পিত বৃক্ষ, নদী, হরিণ শাবক, সকলেই তাঁর হৃদয়ের সন্নিহিত। তাই রাবন যখন তাঁকে
হরণ করে নিয়ে যাচ্ছেন, তখন তিনি আকুল হৃদয়ে জনস্থানের সমগ্র প্রকৃতিকে আহ্বান
জানালেনঃ
“আমন্ত্রয়ে জনস্থানে কর্ণিকারাংশ্চ পুষ্পিতান্।
ক্ষিপ্রং রামায় শংসধ্বং সীতাং হরতি রাবণঃ।।”
-জনস্থানে কর্ণিকার বৃক্ষকুলকে প্রার্থনা করছি, তোমরা
তাড়াতাড়ি রামকে খবর দাও, রাবণ সীতাকে হরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। এরপর তিনি গোদাবরী নদী,
দণ্ডকবনের বৃক্ষদেবতাদের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে রামের কাছে সীতা হরণের খবর পৌঁছে
দিতে বললেন। সবশেষে জনস্থানের মৃগপক্ষী নির্বিশেষে সমগ্র প্রাণীকুলের কাছে
শরণাগতির প্রার্থনা জানালেন। কিন্তু কোন লাভ হলো না। অবশেষে বৃদ্ধজটায়ুকে পাহাড়
চূড়োয় গাছে বসে থাকতে দেখে সীতা তাঁর কাছেও নিজের অসহায় অবস্থা জানিয়ে বিলাপ করতে
লাগলেন। জটায়ু রাবণকে প্রতিহত করতে উদ্যত দেখে করুণাময়ী সীতা বললেন, ‘এই নিষ্ঠুর
বলশালী ও সশস্ত্র রাবণকে আপনি প্রতিহত করতে পারবেন না। আপনি বরং রাম-লক্ষণকে খবর
দিন।’ কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত জটায়ু রাবণের সাথে যুদ্ধে মারা গেলেন। নিরুপায় অসহায়
অনিচ্ছুক সীতাকে রাবণ জোর করে লঙ্কার দিকে উড়িয়ে নিয়ে চললেন। সীতা ব্যাধবদ্ধ
হরিণীর মত সন্ত্রস্তভাবে এদিক ওদিক চাইতে হঠাৎ পর্বত চুড়ায় পাঁচ বানরকে দেখতে
পেলেন। শেষ অবলম্বন হিসেবে উত্তরীয় বস্ত্রে সোনার অলঙ্কার বেঁধে বানরদলের দিকে
ছুঁড়ে দিলেন, এই আশায় যদি তারা শ্রীরামের কাছে সংবাদ পৌঁছে দেয়। এখানেও সীতার
মানুষ ও পশুর মধ্যে অভিন্নদৃষ্টি ফুটে উঠেছে।
রাবণ সীতাকে লঙ্কায় নিয়ে গিয়ে নানারকম লোভ ও ভয় দেখিয়ে
তাঁকে স্ববশে আনার চেষ্টা করে যখন ব্যর্থ হলেন, তখন রাবণ তাঁর দশ মুণ্ড সীতার পায়ে
লুটিয়ে দিয়ে বললেনঃ ‘রাবণ কোন নারীর চরণে মাথা নোয়ায় না। কিন্তু তোমার রূপে আমি
উদভ্রান্ত, মানপমান বোধশূন্য, তাই উদ্ধত রাবণের চির উন্নত মস্তক আজ তোমার পদতলে
লুণ্ঠিত।’ এই অসম্ভব ঘটনার পরও সীতা নিরুত্তর, অবিচল, নিষ্ঠায় দৃঢ়। লঙ্কা রাজ্যের
লোভ, ভোগৈশ্বর্যের মোহ, লঙ্কার দুরধিগম্যতা, রামের দুর্বলতা, তাঁর লঙ্কা প্রবেশের
অবাস্তবতা ইত্যাদি একেক করে বুঝিয়েও সীতার মন টলানো গেল না।
সীতা স্বমতে দৃঢ় থেকে বললেন, “দীর্ঘবাহু বিশালাক্ষো দৈবতং স
পতির্মম।” (অরণ্য কাণ্ড – ৫৬/৩)
অযোধ্যাপতি দশরথের দীর্ঘবাহু বিশাল নেত্রযুক্ত রাম নামে
ত্রিলোক বিখ্যাত যে ধর্মপরায়ণ পুত্র, তিনিই আমার দেবতা, আমার পতি।
আমরা দেখেছি সীতাকে, এক ভয়াবহ ব্যক্তির সামনে তাঁর নানা
কুপ্রস্তাব পদদলিত করে অবিচল নিষ্ঠায় দৃঢ়মতে প্রতিষ্ঠিত থাকতে। চরিত্রের এই দৃঢ়তার
জন্যই তিনি ভারতীয় নারীর আদর্শ। সীতার মন জয়ের সবরকম চেষ্টা ব্যর্থ হলে রাবণ তাঁকে
রাক্ষসী পরিবেষ্টিত পাহারায় অশোকবনে রেখে এলেন। সেখানে রাক্ষসীদের নানা উৎপীড়ন সহ্য
করেও তিনি নিজের সিদ্ধান্ত থেকে একচুল নড়লেন না। তিনি অদ্ব্যর্থব্যঞ্জক ভাষায়
জানিয়ে দিলেনঃ ‘মানুষী কখনো রাক্ষসের ভার্যা হতে পারে না।’ সঙ্কল্পের দৃঢ়তা ব্যক্ত
করার জন্য বললেনঃ
“কামং খাদত মাং সর্বা ন করিষ্যামি বো বচঃ।” (সুন্দরকাণ্ডে –
২৫/৩) – তোমরা সকলে মিলে আমাকে খেয়ে ফেললেও আমি তোমাদের কথা মানব না।
মানুষের মন সাধারণত লোভে, ভয়ে বিচলিত হয়। কিন্তু সীতা
সাধারণের পর্যায়ে পড়েন না। তিনি অযোনিজা, ভুমিজা, তাই ধৈর্যে, সহিষ্ণুতায়,
সঙ্কল্পের স্থিরতায়, ভূমির মত অচঞ্চল।
আবার সীতা সঙ্কল্পে যেমন দৃঢ়, তাঁর হৃদয়ও ততখানি বড়। বুড়ি
ত্রিজটা যখন তর্জনকারিণী রাক্ষসীদের বললেন, ‘রামের জয় নিশ্চিত। রামের কাছ থেকে
তোমাদের জন্য মহাভয় অপেক্ষা করছে। যদি বাঁচতে চাও সীতার শরণাপন্ন হও।’ তখন প্রভুর
বিজয় সম্ভাবনার কথা শুনে রামপ্রিয়া অত্যন্ত আনন্দিত হয়েও সলজ্জভাবে বললেন, ‘যদি
তোমার কথা সত্য হয়, তবে আমি এই নির্যাতন কারিণীদের সকলকে ক্ষমা করে দেব।’
এই ঘটনা সীতার হৃদয়ে উদারতা ও মহত্ব প্রমাণ করে। রাক্ষসীরা
সীতাকে কটুভাষায় ভর্তসনাই করেনি, তাঁর মাংস খাবে বলে শাসিয়েছিল। অনুসূয়া উদার
হৃদয়া তাদের বিপদ থেকে রক্ষা করার ভরসা দিলেন। এ চরিত্রের তুলনা মেলা ভার। এত
উদারতা, এত সহনীয়তা, এত দোষদৃষ্টিশূন্যতা আর কোথায় পাওয়া যাবে!
সীতা চরিত্রে অনেক মহৎ গুণের সমাবেশ ঘটলেও তাঁকে আমরা
মানবীরূপেই দেখি। কবি বাল্মীকি তাঁকে সাধারণ মানবীরূপে এঁকে তাঁর মধ্যে কিছু
অসাধারণত্বের মিশেল দিয়েছেন।
অশোকবনে বন্দিনী সীতাকে দেখে হনুমান তাঁকে ‘সীতা’ বলে
নিশ্চিত হলেও সীতা তাঁকে সহজে বিশ্বাস করতে পারেন নি। তাঁর মন সংশয় দোলায় দুলছিল।
সাধারণ মানুষের মধ্যে যা স্বাভাবিক, সীতার আচরণও এখানে সেরকমই ছিল। সদ্য যিনি
রাবণকে বিশ্বাস করে এই ঘোর বিপদে পড়েছেন, সেই রাবণের ভয় তাঁর মন থেকে মুছে না
যাওয়াই স্বাভাবিক। তাই তিনি হনুমানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। অশোকবনে গাছের ডাল
ধরে দাঁড়িয়ে থাকা অপূর্ব সুন্দরী যুবতীকে দেখে হনুমান তাঁকে দেবী বলেই মনে করে
মিষ্টি কথায় তাঁর পরিচয় জানতে চেয়ে বললেনঃ ‘আপনি কি চাঁদ থেকে খসে পড়া, দেবলোক
থেকে ঝড়ে পড়া, ধরার ধূলায় লুণ্ঠিত নক্ষত্রশ্রেষ্ঠ রোনিনী?’
নিজের মনে নানা রকম সঙ্কল্প-বিকল্প করে হনুমানের সিদ্ধান্ত
হোলঃ ইনি কোন দেবী নন, কেননা, ইনি দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন, ভূমি স্পর্শ করে আছেন; আর
মনে মনে কোন রাজার নাম উচ্চারণ করছেন। অতএব, ইনি মানবী। এনার শরীরের লক্ষণ দেখে
বোঝা যায়, ইনি কোন রাজকন্যা বা রাজমহিষী।
হনুমানের অনুমান অভ্রান্ত কিনা জানার জন্য তিনি এবার সীতাকে
স্পষ্ট করে বললেন, ‘আপনি ঠিক বলুন তো, কে আপনি। আপনার এই অতিমানবীয় রূপ, তপস্বিনী
বেশ, দুঃখভারাক্রান্ত চেহারা দেখে আমার নিশ্চিত বিশ্বাস, আপনি রঘুকুলতিলক
শ্রীরামচন্দ্রের মহিষী।’ হনুমানের মুখে শ্রীরামচন্দ্রের নাম শুনে সীতাদেবী পুলকিত
হয়ে উঠলেন। এবার তিনি হনুমানকে সবিস্তারে নিজ পরিচয় দিলেন।
কথায়-বার্তায়, আলাপ পরিচয়ে পরস্পরের বিশ্বাস উৎপন্ন হলে,
হনুমান ধীরে ধীরে সীতার কাছে আসার চেষ্টা করতে লাগলেন। তাঁকে দেখে সীতার মনে
পূর্বস্মৃতি থেকে ভয়ের সঞ্চার হল। তিনি হনুমানকে স্পষ্ট করে বললেন, ‘আমার মনে
হচ্ছে তুমি সেই রাবণ।’ সীতার এই যে পূর্বস্মৃতি থেকে সংশয় ভয় – এই মানসিক বৃত্তি
স্বাভাবিক এবং মানবিক। এখানে তাঁর দেবীসত্তার কোনা পরিচয় পাওয়া যায় না। সন্দেহবশত
ভয়ের বশীভূত হওয়ার ফলে সীতা আর হনুমানের সাথে কথা বলতে চাইলেন না। এবার হনুমান
রাম-লক্ষণের বীর্য, তাঁদের শারীরিক চিহ্ন ইত্যাদির পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়ে
বললেন, ‘সীতাকে খুঁজে বের করার উদ্দেশ্যে শ্রীরামচন্দ্রের সাথে বানররাজ সুগ্রীবের
বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়েছে। আমি সেই সুগ্রীবের মন্ত্রী। বর্তমানে আমি আপনার কাছে শ্রীরামের
দূত হয়ে এসেছি।’ এরপর সীতার সংশয় সম্পূর্ণরূপে নিরসনের উদ্দেশ্যে হনুমান রামের নাম
লেখা আংটি দেখালেন। এবার তাঁর সম্পূর্ণ সংশয়ের নিরসন হল।
প্রিয়তম পতির খবর পেয়ে ঈষৎ লজ্জাবনতমুখী সীতা সানন্দে
হনুমানের ভূয়সী প্রশংসা করলেন। এখানেও সীতার স্বাভাবিক মানবিক বৃত্তিগুলিরই পরিচয়
পাই। এখানে তাঁকে স্বর্গচ্যুতা দেবী বলে মনে হয় না। ভয়ঙ্কর ঘটনার স্মৃতিতে ভয়, ঐ
ঘটনার স্মৃতিতে অনুরূপ ঘটনার কল্পনাহেতু আগন্তুককে দেখে ভয়, সংশয়, অপরিচিত পরিবেশে
প্রিয়জন বিধুরতায় উদ্বেগ, শুভ সংবাদে আনন্দ – এগুলি সবই সাধারণ মানবীয় বৃত্তি। এত
কিছুর মধ্যে তাঁর চিত্তের দৃঢ়তা, মৃত্যুভয়েও অনমনীয়তা – এগুলি অতি মানবীয় বৃত্তির
পর্যায়ে পড়ে। হনুমানের প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর সীতা শ্রীরামকে
দেখার জন্য চঞ্চল হয়ে উঠলেন। সীতার ব্যাগ্রতা দেখে হনুমান বললেন, ‘রাম সৈন্য
সংগ্রহ করবেন, সাগর পার হবেন, যুদ্ধ করবেন – সে তো অনেক হাঙ্গামার ব্যাপার। এর
চেয়ে বরং তুমি আমার পিঠে বস। আমি তোমাকে আকাশপথে উড়িয়ে মুহূর্তমধ্যে শ্রীরামের
চরণতলে পৌঁছে দিচ্ছি।’ এবার সীতা নানা অছিলা খাড়া করলেন। বললেন, ‘তুমি সমুদ্র আর
আকাশের মাঝখান দিয়ে উড়ে যাবে। আমার খুব ভয় করবে। ভয়ে যদি অজ্ঞান হয়ে সমুদ্রে পড়ে
যাই, হাঙর, কুমীরের পেটে যাব।’ এখানে সীতা যে মৃত্যুভয়ের কথা বলছেন, সেটা কিন্তু
সত্যি নয়। হনুমান তাঁকে সাহস দিয়ে বললেন, ‘আমি থাকতে তোমার ভয় কি মা?’ তবু সীতা
হনুমানের পিঠে বসে আকাশপথে যেতে রাজি হলেন না। তখন হনুমান আবার বললেন, ‘তুমি কেন
যেতে চাচ্ছ না, আমাকে খুলে বল। আমি তোমাকে মা বলেছি, তুমি নিঃসঙ্কোচে মনের কথা
বল।’
এবার সীতা আসল কথাটি প্রকাশ করলেন। তিনি বললেন, ‘পরপুরুষের
স্পর্শেই আমার আপত্তি। রাবণ আমাকে স্পর্শ করেছে সত্যি, কিন্তু সে তো গায়ের জোরে
আমার গায়ে হাত দিয়েছে। আমার অসহায়তার সুযোগ নিয়ে রাবণ আমাকে স্পর্শ করেছে। আমি
স্বেচ্ছায় রাবণকে স্পর্শ করিনি। কিন্তু তোমার পিঠে বসা মানে তো স্বেচ্ছায়
পরপুরুষকে ছোঁওয়া। সেখানেই আমার আপত্তি। আমি তা পারব না।’ ওখানে প্রশ্ন ওঠে, সীতা
যদি হনুমানের পিঠে বসতেন, তাহলে কি জাত যেত? বরং যে রামের দর্শনাকাঙ্ক্ষায় তিনি
উদগ্রীব, শুধু উদগ্রীব বললেই ঠিক বোঝানো হবে না – যার অদর্শনে তিনি জীবনধারণের কোন
প্রয়োজনই অনুভব করেন না, সেই রামের সাথে অচিরেই মিলন হতে পারত, শুধু হনুমানের পিঠে
উঠে বসলে। কিন্তু তাঁর একি মানসিকতা, শুধু স্পর্শভয়ে তিনি তাঁর প্রিয়তম পতির সাথে
মিলিত হওয়ার এই সহজলভ্য সুযোগ অনায়াসেই ত্যাগ করলেন! এই সিদ্ধান্তের সপক্ষে তিনি
যে সব যুক্তি দিয়েছেন, যেমন রামের বীর্যের হানি, অপযশ ইত্যাদি, সেগুলি আধুনিক
যুগের প্রেক্ষিতে একেবারে অচল।
কিন্তু সীতার বিচার করতে গেলে আমাদের রামায়নের যুগের সমাজ
ব্যাবস্থার কথা মাথায় রাখতে হবে। বিশেষত বীরচূড়ামণি রামের মর্যাদার কথা। রঘুকুলবধূ
সীতার মর্যাদার কথা অবশ্যই চিন্তা করতে হবে। হনুমান যতই সীতাকে ‘মা’ বলে সম্বোধন
করুক লোকে তা জানবে না। তাছাড়া অল্প পরিচয়ে হনুমানের মুখে মাতৃ সম্বোধন শুনেই তো সীতার
আড়ষ্টতা কাটা সম্ভব নয়। তার ওপর তিনি আবার সতীত্ব সম্পর্কে অতিমাত্রায় সচেতন। সীতা
স্বয়ং এ বিষয়ে বলেছেনঃ
“ভর্ত্তুরভক্তিং পুরস্কৃত্য রামাদন্যস্য বানর।
নাহং স্প্রষ্টুং স্বতোগাত্রমিচ্ছেয়ম্ বানরোত্তম।।”
(সুন্দরকাণ্ডে ৩৭/২২)
- হে বানরশ্রেষ্ঠ! ‘পতিভক্তির কারণেই ভগবান শ্রীরাম ছাড়া
অন্যকোন পুরুষের শরীর স্বেচ্ছায় স্পর্শ করতে পারি না।’
যে সীতা সাধ্বী পত্নীরূপে পুত্রতুল্য হনুমানের অঙ্গ স্পর্শ
করতে অস্বীকার করলেন, সীতাই স্নেহময়ী মাতৃরূপে হনুমানের আসন্ন বিরহব্যথায় আতুর এবং
তার অমঙ্গল আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন। লঙ্কায় আগুন লাগিয়ে লণ্ডভণ্ড করে দেশে ফিরে যাওয়ার
পূর্বে সীতার কাছে হনুমান বিদায় চাইতে গেলে, সীতা অত্যন্ত ব্যাকুলভাবে তাঁকে আর
একদিন থেকে যেতে বললেন। মায়ের আন্তরিক মমতায় বললেন, ‘আজ কোথাও লুকিয়ে থেকে বিশ্রাম
নাও। সুস্থ হয়ে কাল দেশে ফিরে যেও, বাবা।’ “বিশ্রান্তঃ শ্বোগমিষ্যসি।”
(সুন্দরকাণ্ডে ৫৬ সর্গে ৩য় শ্লোক)। একেবারে স্নেহবিগলিত মাতৃমুখনিঃসৃত ভাষা।
মহর্ষি বাল্মীকি সীতার মানবীরূপেরই কল্পনা করেছেন। তাঁর মধ্যে স্নেহমমতা,
প্রেম-ভালোবাসা, ভয়-উদ্বেগ ইত্যাদি মানবিক বৃত্তির ভূয়সী প্রকাশ ঘটেছে।
রাবণ অনুচর বিদ্যুজ্জিহ্বের সাহায্যে মায়ারচিত
শ্রীরামচন্দ্রের কাটামুণ্ডু ও তাঁর ধনুক দেখে সীতা অজ্ঞান হয়ে গেলেন। সংজ্ঞা ফিরে
পেয়ে পতিকে স্মরণ করে নানাপ্রকার বিলাপ করতে লাগলেন। শোকার্ত বিলাপরতা সীতার মুখের
কথাগুলি অবিকল মানুষের মত। যথা, “সাধু ঘাতয় মাং রামস্যোপরি রাবণ।” – ‘হে রাবণ,
আমাকেও রামের শবের ওপরে শুইয়ে দাও। আমি আর
বেঁচে থেকে কি করব? আমাকে মেরে আমার পতির সহগামিনী করে দাও।’
এখানেও আমরা সীতার মধ্যে কোন দেবীর কল্পনা করতে পারি না।
আবার যুদ্ধের সময় ইন্দ্রজিতের বাণে রাম-লক্ষণ মূর্ছিত হয়ে পড়লে রাবণের আদেশে সীতার
পাহারায় নিযুক্ত রাক্ষসীরা পুষ্পক রথে চড়িয়ে সীতাকে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে গেল।
সেখানেও সীতা তা দেখে আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। তাঁর প্রাকবিবাহের অনেক কথা মনে
পড়ে গেল। লক্ষণজ্ঞ পণ্ডিতেরা বলেছিলেন, ‘সীতা সধবা ও পুত্রবতী থাকবেন।’ সেকথা
স্মরণ করে তিনি বিলাপ করতে করতে বললেন, ‘তাঁদের ভবিষ্যদ্বাণী ব্যর্থ হয়ে গেল!’
এখানেও সীতার ব্যব্যহারে কোন বৈলক্ষণ্য দেখতে পাই না। এখানে সীতাকে আমাদের
মর্ত্যের মানুষই মনে হয়।
ভাগ্যক্রমে বৃদ্ধা ত্রিজটা রাক্ষসী সীতার সহযাত্রী ছিলেন।
তিনি সীতার প্রতি সহৃদয়া। তিনি সীতাকে বুঝিয়ে বললেন, ‘রাম-লক্ষণের মৃত্যু হয়নি
এঁরা শুধু মূর্ছিত হয়ে পড়েছেন। দেখ, এঁদের শরীরে কান্তি এতটুকু ম্লান হয়নি। তাই
তোমার ভয়ের কোন কারণ নেই।’ অতএব ‘ত্যজ শোকম্’- “শোক পরিত্যাগ করো। এঁদের মৃত্যুর
সময় এখনো হয়নি।” একথা শুনে সীতা ত্রিজটাকে করজোড়ে বললেন, ‘এমবন্তু’ – তাই যেন হয়।
অবশেষে ত্রিজটার কথাই সত্য হল। রাম-রাবণের যুদ্ধে রাবণ মারা পড়লেন। রাম-লক্ষণ
বিপন্মুক্ত ও জয়ী হলেন।
কিন্তু সীতার দুঃখের অবসান হল না। যুদ্ধজয়ের পর শ্রীরামের
আদেশে বিভীষণ সীতাকে পাল্কি করে নিয়ে রামের শিবিরের দিকে যাত্রা করলেন। যথাসময়ে
বিভীষণ ধ্যানস্থ শ্রীরামকে সংবাদ দিলেন, “সীতা এসে গেছেন।” শুনে রাম, বিভীষণকে
আদেশ দিলেন, “যাও, সীতাকে সত্ত্বর আমার কাছে নিয়ে এস।”
সীতাকে রামচন্দ্রের কাছে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগে বিভীষণ
আশ-পাশের ভিড় সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। রামচন্দ্র তা দেখে বিরক্ত হয়ে বিভীষণকে
বললেন, ‘এই নিষ্ঠুর কাজ থামাও। এরা সবাই আমার আপনজন।’ ভিড় সরানোর চেষ্টার মাধ্যমে
বিভীষণ যে সীতাকে জনগণের দৃষ্টির সম্মুখ থেকে আড়াল করতে চাইছেন, একথা বুঝতে পেরে
বললেন, ‘স্ত্রীলোকের আবরণ তার সদাচার, পতির কাছে থেকে প্রাপ্য মর্যাদা ইত্যাদি।
নিষ্ঠুরভাবে জনগণকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে নারীর আব্রু বাঁচান যায়না। তা ছাড়া, সীতা এখন
মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, উপরন্তু উনি আমার কাছে আছেন- এজন্য ওঁর এখন কোন আবরণের
প্রয়োজন নেই।’
উৎসুক লোকের প্রচুর ভিড় থাকায় সীতাকে পাল্কি থেকে নেমে
হেঁটে আসার আদেশ দিলেন প্রজাবৎসল শ্রীরামচন্দ্র, যাতে এই বনবাসীরা সীতাকে প্রত্যক্ষ
দর্শন করতে পারে।
বিভীষণ শ্রীরামের আদেশে লজ্জাবনতমুখী সঙ্কোচকুণ্ঠিতা
সীতাদেবীকে পদব্রজেই শ্রীরামচন্দ্রের চরণোপান্তে উপস্থাপিত করলেন। সীতার দুচোখ
আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠল। শ্রীমুখদর্শনে চিরবঞ্চিত শশাঙ্কমুখী সীতা চোখ তুলে
শ্রীরামের পূর্ণচন্দ্রনিন্দিত মুখখানি যেন দৃষ্টি দিয়ে পান করতে লাগলেন। কিন্তু
হায়! ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস! রামচন্দ্র নির্বিকার। তাঁর মুখে ভাব পরিবর্তনের
কোন চিহ্ন নেই।
তিনি নির্বিকার ভাবে সীতাকে যে কঠোর বাক্য শোনালেন, তাতে
তাঁর হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে গেল। রামচন্দ্র বললেন, ‘আমার কাজ শেষ। শত্রুজয় করে তোমাকে
ফিরিয়ে এনেছি; আমার সুপ্রসিদ্ধ বংশের মর্যাদা রক্ষা করেছি। আমার কর্তব্য এইটুকুই।
এবার সীতা, তুমি যেদিকে খুশি যেতে পার, আমার কোন আপত্তি নেই।’ “লক্ষণে বাথ ভরতে
কুরু বুদ্ধিং যথাসুখম্। শত্রুঘ্নে বাথ সুগ্রীবে রাক্ষসে বা বিভীষণে। নিবেশয় মনঃ
সীতে যথা সুখমাত্মনঃ।।” - (যুদ্ধ কাণ্ডে -
১৫ সর্গে ২২-২৩ শ্লোক।) অর্থাৎ সীতা, তুমি লক্ষণ, ভরত, শ্ত্রুঘ্ন, সুগ্রীব বা
বিভীষণ- এদের মধ্যে যাকে তোমার ভালো লাগে তাকেই তোমার মন দিতে পার। তুমি দীর্ঘদিন
পরগৃহে বাস করেছ; তোমাকে আমি আর পত্নীরূপে গ্রহণ করতে পারি না।
লজ্জায়-অপমানে সীতার সোনার বরণ কালো হয়ে গেল। তিনি দু’হাত
দিয়ে কান চাপা দিলেন। আর শুনতে পারছেন না। কোমলাঙ্গী সীতা হস্তিকরাঘাতে আহত লতার
মত মাটিতে পড়ে কাঁদতে লাগলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে বিশাল জনতার
মধ্যে প্রিয়তমের মুখ থেকে ঐরকম কর্কশ-নিষ্ঠুর বাক্য শুনে লজ্জায় অধোমুখী হলেও
অপমানের জ্বালায় আর সতীত্বের তেজে শুকনো ঘাসে আগুন দেওয়ার মতো জ্বলে উঠলেন, তিনি
সুতীব্র ভাষায় রামকে আক্রমণ করে বললেনঃ এ কি রাম! তুমি না নরশ্রেষ্ঠ! তুমি তোমার
প্রজাগণের আদর্শ। তুমি রাজা। তুমি কেন অসভ্য অসংস্কৃত নীচলোকের মত কথা বলছ! তুমি
তোমার পত্নীকে আজও চিনলে না? সেই ছ’বছর বয়স থেকে তোমার সাথে আছি। আজ আমি তিরিশ
বছরের যুবতী দু’যুগ কেটে গেছে তোমার সাথে। একদিনের জন্যও আমি তোমার সঙ্গ ছাড়িনি।
এত সুদীর্ঘকালেও যদি তুমি আমাকে চিনতে না পেরে থাক, তবে আমার মরণই ভালো। রাবণ
আমাকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিল। আমি সাধ করে রাবণের সাথে যাই নি। দেহ আমার আয়ত্তে ছিল
না। কিন্তু হৃদয় মন আমার তোমার চিন্তাতেই বিভোর ছিল। রাবণ আমার দেহটাকে তুলে নিয়ে
গিয়েছিল, হৃদয়টাকে তো ছিঁড়ে নিতে পারে নি। আচ্ছা, তুমি তোমার অনুচর হনুমানকে আমার
খোঁজে পাঠিয়েছিলে, তখন কেন তুমি তার মারফৎ আমাকে ত্যাগ করার কথা বলে পাঠাওনি?
হনুমানের মুখে তোমার এরকম সিদ্ধান্তের কথা জানতে পারলে, আমি লঙ্কার অশোক বনেই
হনুমানের সামনে এ দেহ বিসর্জন দিতাম। তোমাকে এত পরিশ্রম, এত লোকক্ষয় করতে হতো না।
যাক্, সবই আমার কপাল!’ এই বলে লক্ষণের দিকে তাকিয়ে নির্দেশ দিলেন, ‘লক্ষণ চিতা
সাজাও। এক্ষুনি চিতার আগুনে এই রাক্ষস, বানর, ও ঋক সমাজের সামনে সন্দেহদিগ্ধ শরীর
বিসর্জন দেব।’ লক্ষণ ইতস্তত করলেও শ্রীরামের সম্মতিসূচক ইঙ্গিতে চিতা সাজালেন।
রাম, কেন জানি না, মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়েছিলেন। ঐরকম দুর্বিসহ সময়েও সীতা তাঁর
পাতিব্রত ত্যাগ করেননি। তিনি রামকে প্রদক্ষিণ করলেন এবং ধীরে ধীরে চিতার কাছে
গেলেন। দেবতা-ব্রাহ্মণনগণকে যথারীতি প্রণাম জানিয়ে জ্বলন্ত আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে
বললেন, ‘যদি আমার হৃদয় ক্ষণিকের জন্যও শ্রীরামের ভাবনা থেকে সরে না গিয়ে থাকে,
“তথা লোকস্য সাক্ষী মাং সর্বতঃ পাতু পাবকঃ।” – তাহলে সর্বজগৎসাক্ষী অগ্নিদেব আমাকে
সর্বপ্রকারে রক্ষা করুন। আবার বললেন, “যথা মাং শুদ্ধচরিত্রাং দুষ্টাং জানাতি রাঘবঃ
তথা লোকস্য সাক্ষী মাং সর্বতঃ পাতু পাবকঃ।” – আমার চরিত্র যদিও নিষ্কলুষ, তথাপি
রাম আমার চরিত্রে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাই সর্বজগৎসাক্ষী অগ্নিদেব আমাকে সর্বদিক
থেকে রক্ষা করুন।’ তাঁর সতীত্বের শেষ প্রমাণ হিসাবে বললেনঃ “কর্মণা মনসা বাচা যথা
নাতিচরাস্যহম্। তথা লোকস্য সাক্ষী মাং সর্বতঃ পাতু পাবকঃ।” যদি মন, বাক্য ও কর্মের
দ্বারা কখনো রামের আদেশ, নির্দেশ বা মনোভাবের অতিক্রম না করে থাকি, তাহলে অগ্নিদেব
আমাকে সর্বপ্রকারে রক্ষা করুন। এই বলে সীতা জ্বলন্ত চিতা পরিক্রমা করে সবার সামনে
আগুনে প্রবেশ করলেন। তাঁকে এভাবে আগুনে প্রবেশ করতে দেখে ঋষি দেবতা ও গন্ধর্বগণ
ভাবলেন যেন যজ্ঞে পূর্ণাহুতি দেওয়া হচ্ছে। উপস্থিত স্ত্রীলোকেরা চিৎকার করে উঠলেন।
গন্ধর্ব দেবতারা দেখলেন শাপগ্রস্তা কোন দেবী স্বর্গ থেকে নরকে পড়ে যাচ্ছেন। রাক্ষস
বানরেরা ‘হায় হায়!’ করে মহাকোলাহল বাধিয়ে দিল। চতুর্দিক বিষণ্ণ আর্তনাদে ভরে গেল।
এই মর্মন্তুদ অবস্থায় বিচলিত হয়ে দেবতারা সকলে মিলে শ্রীরামের কাছে উপস্থিত হলেন।
স্বয়ং ব্রহ্মা তাঁকে বিষ্ণুর অবতার বলে স্তব করলেন এবং সীতার যথাযথ মর্যাদা দিতে
অনুরোধ করলেন।
অগ্নিদেব স্বয়ং সীতাকে কোলে করে নিয়ে শ্রীরামের হস্তে অর্পণ
করে বললেন, “এষা তে রাম বৈদেহী পাপম স্যাৎ ন বিদ্যতে।” – ‘এই যে রাম, এই নাও তোমার
সীতা – এর মধ্যে কোন পাপ নেই।’ অগ্নিদেব আরো বললেন, ‘সর্বথা বিশুদ্ধ স্বভাব,
নিষ্পাপ সীতাকে গ্রহণ করো; আর আমার আদেশে সীতাকে কোন কঠোর বাক্য বলো না।’
অগ্নিদেবের কথায় রাম সীতাকে গ্রহণ করলেন এবং সীতার প্রতি অন্যায় ব্যবহারের
কৈফিয়ৎস্বরূপ বললেন, ‘আমিও জানি, সীতা নিষ্পাপ। সতীত্বতেজে স্বয়ংরক্ষিতা সীতাকে
স্পর্শ করার সাধ্য কারোর নেই। তবু যাতে লোকে দাশরথি রামকে মূর্খ না বলে, তাই
অগ্নিতে প্রবেশ করতে উদ্যত সীতাকে বাধা দিই নি। এখন সীতার সতীত্ব লোক সমক্ষে
প্রমাণিত হ’ল।”
সীতার
অগ্নিপরীক্ষার পর রাম সীতাকে নিয়ে অযোধ্যায় ফিরে যাচ্ছেন। সীতাকে কোলে নিয়ে রাম
পুস্পকরথে চড়ে বসলেন। ‘অঙ্কেনাদার বৈদেহীং লজ্জমানাং যশস্বিনীম্’ । এখানে আমরা
অবাক হয়ে সীতার ধৈর্য্য, সহনশীলতা এবং রামের প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ লক্ষ করি। যে রাম
সীতাকে এত অপমান করলেন, তিনি বিনা প্রতিবাদে সেই রামের কোলে চড়ে বসলেন। একি দেবী
না মানবী! অবশ্য সীতা আগেই বলেছেন, ‘আমাকে সাধারণ ইতর মেয়েমানুষ মনে করো না। রাজা
জনকের পবিত্র যজ্ঞভূমি থেকে আমার আবির্ভাব। একারণেই সাধারণ মেয়েমানুষ থেকে আমি আলাদা
– আমার মধ্যে দিব্যশক্তি বিদ্যমান।’
এই
দিব্যভাবের প্রকাশ এখানে সমস্ত আড়াল ঠেলে বেরিয়ে পড়েছে। দিব্যশক্তির অধিকারিণী না
হলে কোন সাধারণ রক্তমাংসের নারীশরীর এত অপমান এত অবহেলা সহ্য করে আবার স্বামীর
কোলে চড়ে বসত না। লজ্জায়, ঘেন্নায় ঐরকম স্বামীর ছায়াই মাড়াত না। কিন্তু সীতা শুধু
মানবী নন, তিনি দেবমানবী। তাই তিনি সব ভুলে রামের কোলে চড়ে বসলেন। প্রত্যাবর্তন
পথের বিশিষ্ট স্থান নির্দেশ করতে করতে রাম সীতাকে নিয়ে কিষ্কিন্ধ্যাপুরীতে
পৌঁছুলেন। বন-বল্লরীশোভিত কিষ্কিন্ধ্যা নগরী দর্শনে সীতা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন।
রামের কাছে সপ্রেমে আব্দার করলেন, ‘আমি সুগ্রীবের মুখ্যপত্নী তারা ও অন্যান্য
বানরপ্তনিগণকে সকলকে নিয়ে তোমার সাথে অযোধ্যায় যেতে চাই।’ রাম তৎক্ষণাৎ তা মঞ্জুর
করলেন এবং কিষ্কিন্ধ্যায় বিমান নামিয়ে বানরপত্নীদের বিমানে তুলে নিলেন। সীতা
চরিত্রের এই উদারতা আমাদের মুগ্ধ করে। অপহরণের জ্বালা, বন্দী অবস্থায় নানা
লাঞ্ছনা, শত্রুজয়ের পরও অগ্নিপরীক্ষা এতগুলি তিক্ত অভিজ্ঞতার পর যখন জনকনন্দিনী
নিশ্চিন্তে, নির্ভয়ে, উৎফুল্ল ও লঘুমনে বহুপ্রার্থিত প্রিয়জনের সাথে স্বদেশে
ফিরছেন, তখন তাঁর এই উদ্ভট আব্দার। এরকম অবস্থায় মানুষ সাধারণত একটু নিরিবিলি চায়,
কিন্তু সীতা চাইলেন তার বিপরীত।
এই
দৃষ্টান্তে সীতাকে নিতান্ত সরলা নিরহঙ্কারা বালিকা মনে হয়। তিনি যে সসাগরা ধরণীর
অধীশ্বর অযোধ্যারাজ দশরথের পুত্রবধূ একথা তাঁর মনে উদয় হল না। পদমর্যাদা অনুসারে ঐ
বানরীরা তাঁর সঙ্গে এক পঙক্তিতে বসারই যোগ্য নয়। বিশ্বজননীর ন্যায় তিনি তাঁর
ব্যাপ্ত বিশাল আঁচলের তলে সকলকে আহ্বান জানালেন। উচ্চ-নীচ কোন ভেদবুদ্ধিই তাঁর মনে
ঠায় পেল না।
অযোধ্যায়
মহাসমারোহে রাজ্যাভিষেকের পর শ্রীরামচন্দ্র ঐ আনন্দঘন মুহূর্তের স্মারক হিসেবে
তাঁর বহুমূল্য কন্ঠহার সীতার গলায় পরিয়ে দিলেন। রামের অনুমতি নিয়ে সীতা ঐ
স্মারকহার হনুমানকে দিয়ে দিলেন।
এটি
একটি ছোট্ট ঘটনা। কিন্তু এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে সীতা চরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ফুটে
উঠেছে। অযোধ্যার রাজমহিষীর কাছে একছড়া মুক্তোমালার আর্থিক মুল্য নিতান্তই
অকিঞ্চিৎকর। তবু কেই বা তাঁর প্রিয়জনের আনন্দস্মৃতিজড়িত উপহার পাওয়া মাত্র প্রাণে
ধরে বিলিয়ে দিতে পারে? সীতা পেরেছিলেন। কেননা, সীতার হৃদয় নির্মেঘ আকাশের মত
বিশাল, উদার ও স্বচ্ছ।
সপ্তকাণ্ড
রামায়নের মধ্যে মহর্ষি বাল্মীকি জনকনন্দিনী সীতার চরিত্র এভাবেই অঙ্কিত করেছেন।
এরপর মহর্ষি ‘উত্তরাকাণ্ড’ নামে আরেকটা কাণ্ডের রচনা না করলে শ্রীরামের
রাজ্যাভিষেকের সঙ্গেই সীতার দুঃখের অবসান হোত। কিন্তু ঋষি কবি উত্তরাকাণ্ড রচনা
করে সীতার দুর্বিষহ দুঃখের সাক্ষী আমাদের করে রাখলেন।
যাইহোক,
এবার উত্তরাকাণ্ডের দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। শত্রুজয়ের পর রাম অযোধ্যার
রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে খুব সুন্দরভাবে রাজ্য পরিচালনা করতে লাগলেন।
রাম
প্রতিদিন দরবারে বসতেন প্রজাদের অভাব অভিযোগ শোনার জন্য। সেই দরবারে একদিন
সভাসদদের কাছে জানতে চাইলেন, রাজ্যের প্রজারা তাঁর এবং তাঁর পরিবার সম্বন্ধে কিরকম
আলোচনা করে। নিরুত্তর সভাগৃহে ভদ্র নামে এক সভাসদ উঠে দাঁড়িয়ে বিনীতভাবে বলল,
“মহারাজ সবই তো ভালো কথা শোনা যাচ্ছে। তবে একটা বিষয়ে প্রজাদের খটকা লাগছে যে, রাম
অনেক প্রজাহিতকর কাজ করলেও, পরগৃহবাসী সীতাকে ঘরে তুলে ঠিক কাজ করেননি। তাহলে
আমাদেরও স্ত্রী-কলত্রাদির বিষয়ে ঐরকম আচরণ মেনে নিতে হবে। কেননা, রাজা যেরূপ আচরণ
করেন, প্রজারাও তার অনুরূপ আচরণ করে।” (যথা হি কুরুতে রাজা প্রজাস্তমনুবর্ততে) –
উত্ত্রাকাণ্ডে ৪৩/১৯। এই দারুণ দুঃসংবাদে মর্মাহত রাম ভাইয়েদের ডেকে পাঠিয়ে ভদ্রের
বৃতান্ত জানালেন এবং বললেনঃ ‘পৌরাপবাদো সুমহাংস্তথা জনপদস্য চ। বর্ততে ময়ি বীভৎসা
সা মে মর্মাণি কৃন্ততি।।” – উত্তরাকাণ্ড – ৪৫/৩ । অর্থাৎ সীতাকে নিয়ে নগরবাসী ও
জনপদবাসীর মধ্যে বিশাল অপবাদ ছড়িয়ে পড়েছে এবং তাতে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে।
তোমরা
জান, যুদ্ধজয়ের পর সীতাকে অযোধ্যায় ফিরিয়ে আনার সময়ে আমার মনে সংশয়ের উদয় হয়েছিল।
কিন্তু সীতা অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে নিজেকে নিষ্পাপ প্রমান করেছিলেন। সীতা যে নিষ্পাপ,
একথা জেনে স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র দেবতাগন্ধর্বগণের সামনে তাঁকে আমার হাতে সমর্পণ
করেছিলেন। আমিও আন্তরিকভাবে সীতার পবিত্রতায় বিশ্বাস করে তাঁকে অযোধ্যায় ফিরিয়ে
এনেছিলাম। (অন্তরাত্মা মে বেত্তি সীতাং শুদ্ধাং যশস্বিনীম্।) এতকিছু ঘটনার পরেও প্রজাগণ সীতার নামে কলঙ্ক রটাচ্ছে।
এ কলঙ্ক আমি সইতে পারছি না। আমি সীতাকে ত্যাগ করব বলে মনস্থ করেছি। আমি অপবাদভয়ে
নিজের প্রাণ, এমনকি, তোমাদের সকলকে ত্যাগ করতে পারি। সীতাকে ত্যাগ তো সামান্য
ব্যাপার। এই বলে তিনি লক্ষণকে সীতা বিসর্জনের
আদেশ দিলেন। পরদিন ভোর হতেই লক্ষণ, সুমন্ত্রকে ডেকে রথ প্রস্তুত করতে
বললেন। প্রকৃত তথ্য গোপন করে সীতাকে গঙ্গা তীরবর্তী আশ্রম দেখাবার অছিলায় রথে উঠে
বসতে বললেন। আশ্রম দর্শনের কথা শুনে সীতা আহ্লাদে আটখানা। সেজে গুজে আশ্রমবাসী ঋষি
পত্নীদের জন্য সুন্দর সুন্দর বস্ত্র অলঙ্কারাদি নিয়ে রথে চড়ে বসলেন। হায়
মুগ্ধস্বভাবা সীতা! রাম লক্ষণের গুপ্ত মনো ভাবের কিছুই আঁচ করতে পারলেন না।
গঙ্গাতীরে
পৌঁছে লক্ষণ উচ্চৈঃস্বরে কাঁদতে লাগলেন। সীতা তা দেখে অবাক হয়ে বললেন, ‘সে কি
লক্ষণ! এই গঙ্গাতীর আমার বহু কাঙ্ক্ষিত। আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। এই আনন্দের সময়
তুমি কেঁদে আমার মনকে দুঃখভারাক্রান্ত করে দিচ্ছ কেন?
ইতি
মধ্যে লক্ষণ মাঝিদের দেকে নৌকা আনালেন এবং সযত্নে সীতাকে নৌকায় তুলিয়ে নিয়ে
সাবধানে পরপারে নামিয়ে দিলেন। এবার লক্ষণ যেমন চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না।
করজোড়ে লক্ষণ বললেন, “শ্রীরামচন্দ্র বুদ্ধিমান হয়েও আমাকে এমন এক কাজের ভার
দিয়েছেন, যার জন্য আমাকে আজীবন নিন্দার পাত্র হয়ে থাকতে হবে। যে দায়িত্ব আমার ওপর
অর্পিত হয়েছে, তার কাঁটা আমাকে তীব্র বেদনাবিদ্ধ করেছে। হে বৈদেহি! এরকম নির্মম
আদেশ পালনের পূর্বে আমার মরণ হলেই ভাল হত। হে দেবী ! আমার এতে কোন দোষ ধরবেন না।
আমি আদেশপালনকারী ভৃত্য মাত্র।” এই বলে লক্ষণ সীতার পায়ের তলে লুটিয়ে পড়লেন। সীতা
লক্ষণের ঐরূপ আচরণ দেখে উদ্বিগ্ন হৃদয়ে জিগ্যেস করলেন, “লক্ষণ তোমার হাবভাব আমার
ভাল ঠেকছে না। তুমি সত্যি করে বলো, কী হয়েছে। মহারাজ ভাল আছেন তো? অযোধ্যার সব
কুশল তো?” লক্ষণ আর আত্মসংবরণ করতে না পেরে প্রকৃত সত্য জানিয়ে দিলেন। বললেন, ‘সা
ত্বং ত্যক্তা নৃপতিনা – পৌরাপবাদভীতেন।’ অর্থাৎ “আপনি আমার সামনে নির্দোষ প্রমাণিত
হওয়া সত্ত্বেও মহারাজ শুধু লোকনিন্দার ভয়ে আপনাকে ত্যাগ করেছেন।”
লক্ষণের
মুখ থেকে অত্যন্ত রূঢ় ও নির্মম কথা শুনে সীতা মূর্ছিত হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন।
মুহূর্তকালমধ্যে চেতনা ফিরে এলে হতভাগিনী জনকনন্দিনী বেদনার্তবচনে লক্ষণকে বলতে
লাগলেন, “বিধাতা আমার এই শরীর দুঃখভোগের জন্যেই সৃষ্টি করেছেন। পূর্বে যে আশ্রমে
ছিলাম তাতে আমার কোন দুঃখানুভব হয়নি, কেননা আমি তখন রামচন্দ্রের পদাঙ্ক অনুসরণ
করেই নির্বিঘ্নে, ও নির্ভয়ে ও আনন্দে ছিলাম। এখন একলা এই বনাশ্রমে আমি কেমন করে
থাকব? কষ্ট হলে কাকে সে কষ্টের কথা জানাব? শোন লক্ষণ, আজ আমি এই জাহ্নবীর জলে এ
পোড়াশরীর বিসর্জন দিতাম। কিন্তু তা পারছি না, কারণ ওরকম করলে আমার পতির বংশ নষ্ট
হয়ে যাবে। যাইহোক, লক্ষণ! তুমি অভাগিনী আমার কথা ভেবো না। তুমি রাজার নির্দেশ পালন
করো। আর শোন, শাশুড়িদের সবাইকে আমার প্রণাম জানাবে। মহারাজকে আমার প্রণাম জানিয়ে
আমার পক্ষ থেকে কুশল জিজ্ঞাসা করবে। অন্তঃপুরের সমস্ত পুজনীয়া স্ত্রীগণকে আমার
পক্ষ থেকে প্রণাম জানিয়ে আমার খবর ওনাদের জানিয়ে দিও।” এরপর শ্রীরামচন্দ্রকে তাঁর
এই বক্তব্য জানিয়ে দিতে বললেন, “আমার কারণে আপনার যে অপবাদ ঘটেছে, তা দূর করাও
আমার কর্তব্য। কেননা, আপনিই আমার পরম আশ্রয়।” শ্রীরামচন্দ্রের উদ্দেশ্যে তিনি আরও
বললেন, “তিনি যেন খুব সর্তকভাবে ধর্মানুসারে রাজ্যশাসন করেন এবং প্রজাবৃন্দের সাথে
ভাই-এর মত ব্যাবহার করেন। এটাই তাঁর ধর্ম এবং এতেই তাঁর যশোবৃদ্ধি হবে। আমার এ ছার
শরীরের কথা আমি ভাবি না। আমার মতে ‘পতির্হি দেবতানার্্যঃ পতির্বন্ধঃ পতির্গুরুঃ।’
– পতিই স্ত্রীলোকের দেবতা, পতি বন্ধু এবং পতিই গুরু। তাই প্রান দিয়েও পতির প্রিয়কার্্য
সাধন করা উচিত।” এ পর্যন্ত বলে সীতা লক্ষণকে (যে লক্ষণ তাঁর চরণ ছাড়া শরীরের অন্য
অঙ্গ দর্শন করেন নি) বললেন; “আজ আমার শরীরের দিকে দৃষ্টিপাত করো – দেখো, আমি
অন্তঃসত্ত্বা” লক্ষণ লজ্জাবনত মুখে সীতাকে প্রণাম জানিয়ে নৌকায় চড়ে ওপারে চলে
গেলেন। সীতা একলা নদীর পাড়ে নিরুপায় অবস্থায় অসহায়ের মত পড়ে রইলেন।
সীতা
চরিত্রের এই অংশ বিশ্লেষণ করা বড় দুরূহ। দুঃসাধ্য কর্ম। কেননা, সীতা এখানে মানব
মনের দুরধিগম্যা। পতিকর্তৃক অপমানিত হয়েও তাঁর অবিচল পতিপ্রেম, নিদারুন দুঃখেও
বৃক্ষসম সহিষ্ণুতা এবং সর্বোপরি ঐ মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যেও অচঞ্চলবুদ্ধিতে
কর্তব্যাকর্তব্য নির্ণয় করা এক অসম্ভব ব্যাপার। আমাদের সাধারণ বুদ্ধিতে কুলায় না।
এ কি করে সম্ভব! প্রিয়পতি কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েছেন জেনে তিনি মুহূর্তের জন্য
সংজ্ঞা হারালেও, সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে দুঃখার্ত হলেও একটিও অসংযত বাক্য উচ্চারণ করেননি।
বরং তাঁর দুঃখের জন্য বিধাতাকে দায়ী করেও কর্তব্য ভোলেননি। বাল্মীকি খবর পেয়ে
সীতাকে নিজ আশ্রমে নিয়ে গিয়ে কন্যাস্নেহে রক্ষণাবেক্ষণ করেন। ঐ আশ্রমেই সীতা যমজ
পুত্রদ্বয় প্রসব করেন। তারপর দীর্ঘকাল কেটে গেছে। সীতার আর কোন খবর মহর্ষি দেন নি।
অযোধ্যারাজ রামচন্দ্র অশ্বমেধ যজ্ঞ করতে মনস্থ করলেন।
যথারীতি যজ্ঞ শুরু হল। যজ্ঞ চলাকালে মহর্ষি বাল্মীকি ঋষিদের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে
পর্ণকুটির নির্মাণ করতে লাগলেন। মহর্ষির নির্দেশানুসারে তাঁর দুই শিষ্য লব ও কুশ
সুমধুর সুরে রামায়ণ গান করে বেড়াতে লাগলেন। রাজার কানেও সে সুরের ঝঙ্কার ঝঙ্কৃত
হল। তাঁদের অপূর্ব গান যজ্ঞে উপস্থিত শ্রোতারা মুগ্ধ বিস্ময়ে শুনতে লাগলেন। সভাস্থ
মুনি-ঋষি ও রাজন্যবর্গ ঐ বালক দুটির পানে এমন ভাবে বারবার দেখছিলেন যে, মনে হল যেন
তাঁরা দুচোখ দিয়ে ওদের রূপমাধুরী পান করছিলেন, “এই দুই কুমারের চেহারা হুবহু
রামচন্দ্রের মত – যেন বিম্ব আর প্রতিবিম্ব।” স্বয়ং রামচন্দ্র এসে বালকদ্বয়কে
জিজ্ঞাসা করে জানলেন, এই গীতিকাব্যের রচয়িতা মহর্ষি বাল্মীকি এবং তিনি এই
যজ্ঞস্থলেই উপস্থিত আছেন। বালকেরা আরো জানালেন, “আমাদের গুরু মহর্ষি বাল্মীকি
আপনার জীবন দিয়ে এই কাব্যগান রচনা করেছেন এবং এতে আপনার জীবনের সমস্ত ঘটনা ধরা
আছে।” একথা জানার পর রাজা ঐ দুই ভাইকে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে গান শোনাতে বললেন।
ঐ গান শুনতে শুনতেই রাজা জানতে পারলেন, ঐ গায়ক বালকদুটি
সীতার পুত্র কুশ ও লব। একথা জেনে তিনি শুদ্ধসত্ত্ব বুদ্ধিমান দূতগণকে মহর্ষি
বাল্মীকির কাছে তাঁর এই বার্তা পৌঁছে দিতে বললেনঃ “সীতা যদি নিষ্পাপ হন এবং তাঁর
চরিত্র যদি নিষ্কলঙ্ক হয়, তবে তিনি ইচ্ছা করলে মহর্ষির অনুমতি নিয়ে প্রজাপুঞ্জের
সম্মুখে তাঁর শুদ্ধতার প্রমাণ দিতে পারেন। এ প্রস্তাবে রাজি হলে আগামীকাল প্রভাতেই
তিনি রাজসভা মাঝে দাঁড়িয়ে আমার কলঙ্ক অপনয়নের উদ্দেশ্যে শপথপূর্বক বলুন যে, তিনি
নিষ্কলঙ্ক ও সতী।”
রাজদূতগণের মুখে রাজার এই বার্তা শুনে “তাই হোক। কেননা,
পতিই স্ত্রীলোকের দেবতা।” – মহর্ষি মন্তব্য করলেন।
দূতগণের মুখে মহর্ষির সম্মতিসূচক বাক্য শুনে রাজা সভায়
উপস্থিত মুনি-ঋষিগণকে সশিষ্য, রাজন্যবর্গকে সসেবক ও অন্যান্য আগ্রহী ব্যক্তিগণকে
আগামীকাল যথাসময়ে সভায় উপস্থিত হয়ে সীতার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করার
আমন্ত্রণ জানালেন।
পরদিন প্রভাতে রাজা যজ্ঞশালায় উপস্থিত হলেন। বশিষ্ঠ,
ব্যাসদেব, বিশ্বামিত্রাদি বড় বড় ঋষি, মহর্ষিরা কৌতূহলাক্রান্ত হয়ে সেই যজ্ঞশালায়
উপস্থিত হয়েছেন। রাক্ষস, বানর, ভল্লুকেরাও সমাগত। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য,
শূদ্র সব বর্ণের মানুষের মেলা লেগেছে। সীতার শপথগ্রহণ চাক্ষুষ করার জন্য
জ্ঞাননিষ্ঠ, কর্মনিষ্ঠ এবং যোগনিষ্ঠ ব্যক্তিগণ দাশরথি রামচন্দ্রের যজ্ঞাগারে সমবেত
হয়েছেন। সেই পরমমুহূর্ত দর্শনের আকাঙ্ক্ষায় সভায় সমাগত ব্যক্তিবর্গ যেন পাথরের মত
নিশ্চল হয়ে বসে আছেন। “সভা প্রস্তুত” একথা শোনামাত্র মহর্ষি বাল্মীকি সভায় প্রবেশ
করলেন। বাল্মীকির পিছন পিছন হাতজোড় করে, অবনত মস্তকে সীতাও সভায় প্রবেশ করলেন।
তাঁকে সভায় প্রবেশ করতে দেখে সভামধ্যে মহাকলরোল উঠল। স্বয়ং শ্রুতি যেন ব্রহ্মার
অনুসরণ করে চলেছেন – চতুর্দিক থেকে সাধুবাদ ধ্বনিত হতে লাগল! কেও বলল, “ধন্য
সীতা।” কেও বলল “ধন্য রাম।” কেউবা গলা ফাটিয়ে দুজনকেই সাধুবাদ দিতে লাগল।
ঐরকম কোলাহলপূর্ণ জনতার মধ্যে সীতাকে নিয়ে মহর্ষি বাল্মীকি
প্রবেশ করে শ্রীরামচন্দ্রকে বললেন, “রঘুনন্দন! ইনি সেই সীতা, যাকে আপনি লোকনিন্দার
ভয়ে আমার আশ্রমের কাছে ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু ইনি ধর্মপরায়ণা ও উত্তমব্রত
পালনকারিণী। আজ এই সভামধ্যে সীতা পবিত্রতার শপথ গ্রহণ করে, আপনারা অবিশ্বাস দূর
করে, বিশ্বাস উৎপাদন করাতে চান। আপনি অনুমোদন করুন।” মহর্ষি আরো বললেন, “এই দুই
কুমার আপনার পুত্র। একথা একশ শতাংশ সত্যি। আমি প্রচেতার (বরুণ) দশম পুত্র। কখনো
মিথ্যা বলেছি, একথা আমার স্মরণে আসে না।”
এরপর বাল্মীকি সীতার সততার প্রমাণ দিতে নিজেই শপথ গ্রহণ
করতে লাগলেন। বললেন, “আমি বহু হাজার বছর তপস্যা করেছি। সীতা যদি নষ্ট চরিত্র হন,
তবে আমার সেই তপস্যার ফলও নষ্ট হয়ে যাবে। আমি মন, কর্ম বা বাক্য দ্বারা কখনো
পাপাচরণ করিনি। সীতা যদি নিস্পাপ হন, তবে আমি সেই পুণ্যকর্মের ফল ভোগ করতে পারব।
হে রাঘব! বনের ঝরনার ধারে নিঃসঙ্গ সীতাকে দেখে মন, বুদ্ধি ও পঞ্চ ইন্দ্রিয় দ্বারা
বিশুদ্ধ জেনেই তাঁকে আমার আশ্রমে নিয়ে গিয়েছিলাম। ইনি সম্পূর্ণ পবিত্র, নিস্পাপ
এবং পতিকেই দেবতা বলে মান্য করেন। আপনি লোকনিন্দার ভয়ে এঁকে পরিত্যাগ করেছিলেন।
এখন নিজের শুদ্ধতার বিষয়ে আপনার বিশ্বাস জন্মাবেন। হে রাজকুমার, ইনি যে পবিত্র, সে
কথা আমি দিব্যদৃষ্টির সাহায্যে জেনে নিয়েছিলাম। আপনিও জানতেন, ইনি নিষ্পাপ। তাছাড়া
ইনি আপনার প্রাণ অপেক্ষাও প্রিয়। তথাপি লোকনিন্দার ভয়ে আপনি আপনার প্রাণাধিকাকে
ত্যাগ করেছিলেন।”
একথা শুনে শ্রীরামচন্দ্র উঠে করজোড়ে বললেন, “হে ঋষিবর আপনি
যা বলেছেন, সব ঠিক। আমি নিষ্পাপ জেনেও সীতাকে ত্যাগ করেছিলাম। এর আগেও একবার
দেবতাদের সম্মুখে সীতা সতীত্বের পরীক্ষা দিয়েছিলেন। তারপরই আমি সীতাকে রাজমহলে
প্রবেশ করিয়েছিলাম। কিন্তু মুনিশ্রেষ্ঠ, তথাপি লোকনিন্দা এত তীব্র যে, তার ভয়ে আমি
সীতাকে নির্বাসিত করেছিলাম। আমার এ অমার্জনীয় অপরাধের জন্য আমি আন্তরিকভাবে আপনার
কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আপনি সাধনসিদ্ধ ঋষি। আপনার কথাতেই সীতার পবিত্রতা ও
নিষ্কলুষতা বিষয়ে আমার বিশ্বাস জন্মেছে। তথাপি এই প্রজাবৃন্দের, উপস্থিত
রাজন্যবর্গের ও নানা দেশাগত জনতার সম্মুখে সীতা যদি তাঁর নিষ্পাপ চরিত্রের প্রমাণ
দেন, তাহলে আমি আরো বেশী আনন্দিত হব।”
শ্রীরামচন্দ্রের মুখনিঃসৃত ঐ বাক্য শুনে বিশাল জনসমুদ্রের
মধ্যে জনকনন্দিনী শ্রীরামের ছায়া সীতা করজোড়ে উঠে দাঁড়ালেন। গেরুয়াবসনে তপস্বিনীর
বেশে আনত মুখে নিম্নপ্রসারী দৃষ্টি নিয়ে তিনি শপথ বাক্য উচ্চারণ করতে লাগলেনঃ
‘যে যথাহং রাঘবাদ্যং মনসান চিন্তয়ে।
তথা মে মাধবী দেবী বিবরং দাতুমর্হতি।।
মনসা কর্মণা বাচা যথা রামং সর্মচয়ে।
তথা মে মাধবী দেবী বিবরং দাতুমর্হতি।।
যথৈ তৎ সত্যমুক্তং মে বেদ্মি রামাৎ পরং ন চ।
তথা মে মাধবী দেবী বিবরং দাতুমর্হতি।।
সীতা তিনবার শপথ বাক্য উচ্চারণ করলেন। যথাঃ
১) “আমি যদি রাম ছাড়া মনে মনেও অন্য পুরুষের চিন্তা না করে
থাকি, তাহলে হে ধরিত্রীদেবী তুমি বিদীর্ণ হও – আমাকে তোমার কোলে স্থান দাও।”
২) “আমি যদি মন, কর্ম ও বাক্যের দ্বারা রামেরই অর্চনা করে
থাকি, তাহলে হে ধরণী দেবী দ্বিধা হও, আমায় তোমার অঙ্কে স্থাপন কর।”
৩) “আমি যদি একথা সত্য বলে থাকি যে, রাম ছাড়া অন্য কোন
পুরুষকে আমি জানি না তাহলে হে বসুধাদেবী, তুমি দ্বিধা হও – আমাকে তোমার কোলে তুলে
নাও।”
সীতা যখন এরকম শপথ গ্রহণ করছিলেন, তখন মাটি ভেদ করে ভূতল
প্রদেশ থেকে এক সুন্দর দিব্য সিংহাসন উঠে এল। সিংহাসনের সাথে ধরণীর অধিষ্ঠাত্রী
দেবী দিব্যরূপে প্রকট হয়ে দুহাত বাড়িয়ে সীতাকে অভ্যর্থনা জানালেন এবং তাঁকে
সিংহাসনে বসিয়ে দিলেন। এদৃশ্য দেখে দেবতারা তাঁর ওপর পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগলেন।
সীতার কাহিনী এখানেই শেষ হল। কিন্তু শেষ হয়েও হলো নাকো শেষ। কয়েক হাজার বছর কেটে
গেল। সীতাকে নিয়ে এখনো মানুষের কৌতূহলের অন্ত নেই। সমগ্র ভারতের (বিশেষত উত্তর,
পশ্চিম ও মধ্যভারতে) সীতার প্রতিমা ঘরে ঘরে পূজিত হয়।
আদি কবি তাঁর মহাকাব্যে সীতাচরিত্র এঁকেছেন তাঁর হৃদয়ের
ঐকান্তিক ভালোবাসা দিয়ে। এখন বিচার্য, এ চরিত্র কি কবির নিছক কল্পলোকের সৃষ্টি, না
সত্যিই কোন রক্তমাংসের মহীয়সী মাতৃচরিত্রের আদলে কবির লেখনী ফুটে ওঠা এক আদর্শ
নারীর ছবি?
যদি কবির কল্পলোকের সৃষ্টি হয়, তো তার মধ্যে কিছু আতিশয্য
থাকতেই পারে। কিন্তু সে আতিশয্য চরিত্রের মুখ্যরূপকে আচ্ছাদিত করতে পারে না।
আতিশয্য থাকা সত্ত্বেও সে চরিত্র আদর্শ হয়ে উঠতে পারে। যারা আবেগ বিলাসী তাঁরা
সীতা চরিত্রের আতিশয্যকে দেবীমহিমা মনে করেন। যারা যুক্তিবাদী চিন্তাশীল তাঁরা
আতিশয্যের তুলির রঙ ঘসে প্রকৃত তথ্যটুকু গ্রহণ করেন।
সীতা যদি দেবী হন, তাহলে তাঁর অতিমানবিক গুণাবলী থাকা
স্বাভাবিক। আমরা মানুষ। তাই আমাদের মধ্যে ঐরকম অসাধারণ গুণাবলী নেই। সীতার
লাঙ্গলের ফলার মুখে ধরিত্রীর গর্ভ থেকে উদ্ভব, তাঁর শেষ মুহূর্তে ধরণীর গর্ভে
বিলীন হয়ে যাওয়া, জ্বলন্ত চিতা থেক অবিকৃত শরীরে ফিরে আসা – ইত্যাদি ব্যাপারে
তাঁকে দেবীরূপে প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যেই হয়তো কবি তাঁর চরিত্রে ঐরকম অতিমানবিক
বৈশিষ্ট্য আরোপ করেছেন। ঐ অস্বাভাবিক ঘটনা তাঁকে হাজার হাজার বছর ধরে দেবীর আসনে
বসিয়ে রেখেছে, এরকম ভাবলে ভুল হবে। ঐগুলি বাদ দিলেও সীতা চরিত্রের মহিমা
বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয় না।
সীতার পতিপ্রেম, ত্যাগ, গুরুজনে ভক্তি, সরলতা, সহিষ্ণুতা,
দৃঢ়নিষ্ঠা , বদান্যতা, বিপৎকালে স্থৈর্য ও কর্তব্যনিষ্ঠা – যে কোন যুগে যে কোন
সমাজের নারীজাতির আদর্শ। আদর্শ মানে হুবহু তাই হয়ে ওঠা নয়, তাকে সামনে রেখে তার মত
হওয়ার চেষ্টা করা।
স্বামীজি নারী জাতির আদর্শ ‘সীতা’ বলতে ঐরকম একটা
প্রচেষ্টার কথাই বলতে চেয়েছেন।
ওঁ
রঘুনাথায় নাথায় সীতায়াঃ পতয়ে নমঃ।
সমাপ্ত
“মুক্তির
জন্য আগ্রহী সকলে শ্রবণ করো। যাকে পরমাশক্তিরূপে বর্ণনা করা হয়, সেই অব্যয়
অদ্বিতীয়া ব্রহ্মস্বরূপিণীর সাথে ‘আমি’ অভিন্না। এই ‘আমি’ পরমেশ্বরেরই প্রকাশ” –
করুণাময়ী সীতাদেবী
No comments:
Post a Comment