পূর্বে আমরা দ্রৌপদী,
কুন্তি ও অহল্যা
সম্পর্কে জেনেছিলাম। আমরা রামায়নে রাবণ পত্নী মন্দোদরী’র নাম সকলেই শুনেছি। তিনি ছিলেন ভীষণ
ভাবে পতিব্রতা, তা
সত্ত্বেও তিনি রাবনণের মৃত্যুর পরে বিধবা মন্দোদরী তাঁর দেওর বিভীষণকে পতিরূপে
গ্রহণ করেছিলেন। এটাই ছিল দু-এক লাইনে মন্দোদরীর সংক্ষিপ্ত চরিত্র।
তিনিও ছিলেন পঞ্চকন্যার অন্যতম, আমরা
পুনরায় সেই শ্লোকটি দেখে নিই-
‘অহল্যা, দ্রৌপদী, কুন্তি, তারা মন্দোদরী তথা।
পঞ্চ কন্যাং স্মরেন্নিত্যং মহাপাতক নাশনম্ ।।’
পঞ্চ কন্যাং স্মরেন্নিত্যং মহাপাতক নাশনম্ ।।’
অহল্যা, দ্রৌপদী, কুন্তি, তারা ও মন্দোদরী এই পঞ্চ কন্যার নিত্য
স্মরণে মহাপাপ
নাশ হয়। কেন তাঁর নিত্য স্মরণে মহাপাপ নাশ হয় তা আমরা কয়েকটি পর্বে দেখব,
এবং যার জন্য দেখতে
পাব সেটি অবশ্যই বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনের “চরৈবেতি”।
মন্দোদরী
লেখকঃ – চন্দ্রকিশোর তানেজা
লঙ্কেশ্বর রাবণের
পত্নী মন্দোদরী।
দৈত্যবংশে জন্ম। পিতা দিতিপুত্র ময়দানব। স্বর্গের অপরূপা সুন্দরী অপ্সরা
হেমার গর্ভে জন্ম। জন্মসূত্রে দানবী এই মন্দোদরী রাক্ষসরাজ রাবণের পত্নী
কিভাবে হলেন? ভগিনী
শূর্পণখাকে পাত্রস্থ করে রাবণ বনে শিকার করে বেড়াচ্ছিলেন। সেই বনে কন্যাসহ দিতিপুত্র
ময়দানবকে দেখে রাবণ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কে? নির্জন এই বনে আপনি একা কি করছেন?
আপনার সঙ্গে ঐ
এণাক্ষী সুন্দরী
কন্যাই বা কে?’
ময় তাঁর উত্তরে
জানালেনঃ দেবতারা তাঁকে হেমা নামে অপ্সরাকে পত্নীরূপে দান করেছিলেন।
তার প্রীতির জন্য আমি মায়াবলে এক সোনার নগর নির্মাণ করেছিলাম। কিন্তু
দেবকার্যে সে একদিন স্বর্গে চলে গেল। দেখতে দেখতে চৌদ্দ বছর কেটে গেল। সে আর
ফিরে এল না। তার অভাবে আমার সোনার সংসার অসার মনে হতে লাগল। সংসারের সব রস
যেন সে নিংড়ে নিয়ে চলে গেছে। গভীর মনোবেদনায় আমি নিতান্ত দীন অবস্থায় এই
কন্যাকে নিয়ে নগর ছেড়ে বনে এসেছি। তাছাড়া এই কন্যার জন্য উপযুক্ত পাত্রের
সন্ধান করাও আমার উদ্দেশ্য।
এই পর্যন্ত বলে ময়
রাবণকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমার
কথা সব বললাম। এবার আপনি কে, একথা কি জানতে পারি?’ রাবণ নিজ পরিচয় দিলে দৈত্যরাজ ময়
সংলাপরত ব্যক্তিকে
মহর্ষি বিশ্বশ্রবার পুত্র জেনে সানন্দে তাঁর হাতে কন্যা সম্প্রদান করতে ইচ্ছুক হলেন। নিজকন্যার
হাত রাবণের হাতে দিয়ে বললেনঃ
“ইয়ং মমাত্মজা রাজন্
হেময়াপ্সরসা ধৃতা।
কন্যা মন্দোদরী নাম পত্ন্যর্থং গৃহ্যতাম্ ।।”
কন্যা মন্দোদরী নাম পত্ন্যর্থং গৃহ্যতাম্ ।।”
হে রাজন্, হেমানাম্নী অপ্সরার গর্ভে জাত মন্দোদরী
নামে আমার এই কন্যাকে পত্নীরূপে গ্রহণ করুন। রাবণ, ‘তাই হোক’ বলে অগ্নিসাক্ষ্য করে মন্দোদরীর পাণিগ্রহণ
করলেন। এই হল মন্দোদরীর পূর্বপরিচয়। এতে আর নূতনত্ব কী আছে? এরকম ঘটনা ঘরে ঘরে ঘটে, আজো ঘটে চলেছে।
তবে মন্দোদরীর
বৈশিষ্ট্য কী, যে কারণে
প্রাতঃস্মরণীয়া, পাপস্খালনকারিনী
পঞ্চকন্যার অন্যতমা বলে তাঁর নাম উল্লিখিত হয়েছে? সেই বৈশিষ্ট্যগুলির অনুসন্ধান করাই এই
প্রবন্ধের উদ্দেশ্য।
মন্দোদরী অপূর্ব
সুন্দরী। রাবণের অন্দরমহলে হনুমান সহস্র নারীর মধ্যে মন্দোদরীকে দেখে থমকে গিয়েছিলেন। তাঁকে
সীতা ভেবে আনন্দিত হয়েছিলেন।
“গৌরীঃ
কনকবর্ণাভামিষ্টামন্তঃ পুরেশ্বরীম্।
কপির্মন্দোদরীং তত্র শয়ানাং চারুরূপিণীম্।।
স তাং দৃষ্টা মহাবাহুর্ভূষিতাং মারুত্মাজঃ।
তর্কয়ামাস সীতেতি রূপযৌবন সম্পদা।।” – (সুন্দরকাণ্ড ১০ম সর্গ – ৫২-৫৩ শ্লোক )
কপির্মন্দোদরীং তত্র শয়ানাং চারুরূপিণীম্।।
স তাং দৃষ্টা মহাবাহুর্ভূষিতাং মারুত্মাজঃ।
তর্কয়ামাস সীতেতি রূপযৌবন সম্পদা।।” – (সুন্দরকাণ্ড ১০ম সর্গ – ৫২-৫৩ শ্লোক )
সোনার মত গৌরবরণী,
সুসজ্জিতা, অপরূপা, রূপযৌবনশালিনী মন্দোদরীকে দেখে ইনিই
সীতা কিনা এই ভ্রমে পড়েছিলেন হনুমান।
মন্দোদরী পতিপ্রিয়া, ধর্মজ্ঞা, ন্যায়নীতি পরায়ণা। রাম-রাবণের যুদ্ধে রাবণ পরাস্ত ও নিহত হলে মন্দোদরী করুণভাবে বিলাপ করতে লাগলেন। তিনি পতিগর্বে এত গর্বিত যে, তাঁর পতি যুদ্ধে নিহত তো দূরের কথা, পরাজিতও হতে পারেন একথা তাঁর ক্লপ্নার অতীত। তাঁর পতি যে কত বড় বীর, নানাভাবে তার উল্লেখ করে, সকরুণ বিলাপ করতে লাগলেন। শক করতে করতে তিনি বললেনঃ ‘হে মহাবাহ, আপনি, আপনি ক্রুদ্ধ হলে দেবরাজ ইন্দ্রও আপনার সামনে দাঁড়াতে পারতেন না। মহর্ষি, গন্ধর্ব এবং চারণগণও আপনার তেজ সহ্য করতে পারতেন না। হে রাক্ষসরাজ! হে লঙ্কেশ্বর! সামান্য মানুষের কাছে আপনি পরাজিত হলেন! আপনার লজ্জা করে না? ত্রৈলোক্যবিজয়ী, ঐশ্বর্য সম্পন্ন রাবণের তেজ ও বীর্য সহ্য করা যে কোন প্রাণীর পক্ষে সম্ভব নয়, সেই দুর্ধর্ষ বীরকে সামান্য বনচারী মানুষ কিভাবে মেরে ফেলল? হে স্বেচ্ছারূপধারী, আপনি যে সকল স্থানে বিচরণ করতেন, সে সকল স্থানে পৌছুনো কোন মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। শুধু তাই নয়, ঘন ঘন রূপ ও স্থান পরিবর্তন করার ফলে আপনাকে চিহ্নিত করে লক্ষ ভেদ করাও সম্ভব নয়। তবু আপনাকে রাম নামে বনচারী মানুষ বাণের নিশানায় তাক করে ফেলল! এ আশ্চর্য, অত্যাশ্চর্য! একথা কোনমতেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না।’ বিলাপ করতে করতে মন্দোদরীর মনে অন্যভাবের উদয় হোল। যেহেতু তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, কোন মানুষ রাবণকে মারতেই পারে না, অতএব মানুষের রূপ ধরে যুদ্ধক্ষেত্রে কোন দেবতার আবির্ভাব হয়েছিল। কিন্তু দেবরাজ ইন্দ্রও যার সামনে দাঁড়াতে পারেন না, তাহলে সেই বীরপুঙ্গব লঙ্কেশ্বরকে মারল কে? নাঃ, এ কোন দেবতার কর্ম নয়। স্বয়ং যমরাজ অতর্কিত মায়া রচনা করে রামরূপে যুদ্ধক্ষেত্রে রাবণের বিনাশের জন্য অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তা না হলে রাবণকে মারল কে?
মন্দোদরী পতিপ্রিয়া, ধর্মজ্ঞা, ন্যায়নীতি পরায়ণা। রাম-রাবণের যুদ্ধে রাবণ পরাস্ত ও নিহত হলে মন্দোদরী করুণভাবে বিলাপ করতে লাগলেন। তিনি পতিগর্বে এত গর্বিত যে, তাঁর পতি যুদ্ধে নিহত তো দূরের কথা, পরাজিতও হতে পারেন একথা তাঁর ক্লপ্নার অতীত। তাঁর পতি যে কত বড় বীর, নানাভাবে তার উল্লেখ করে, সকরুণ বিলাপ করতে লাগলেন। শক করতে করতে তিনি বললেনঃ ‘হে মহাবাহ, আপনি, আপনি ক্রুদ্ধ হলে দেবরাজ ইন্দ্রও আপনার সামনে দাঁড়াতে পারতেন না। মহর্ষি, গন্ধর্ব এবং চারণগণও আপনার তেজ সহ্য করতে পারতেন না। হে রাক্ষসরাজ! হে লঙ্কেশ্বর! সামান্য মানুষের কাছে আপনি পরাজিত হলেন! আপনার লজ্জা করে না? ত্রৈলোক্যবিজয়ী, ঐশ্বর্য সম্পন্ন রাবণের তেজ ও বীর্য সহ্য করা যে কোন প্রাণীর পক্ষে সম্ভব নয়, সেই দুর্ধর্ষ বীরকে সামান্য বনচারী মানুষ কিভাবে মেরে ফেলল? হে স্বেচ্ছারূপধারী, আপনি যে সকল স্থানে বিচরণ করতেন, সে সকল স্থানে পৌছুনো কোন মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। শুধু তাই নয়, ঘন ঘন রূপ ও স্থান পরিবর্তন করার ফলে আপনাকে চিহ্নিত করে লক্ষ ভেদ করাও সম্ভব নয়। তবু আপনাকে রাম নামে বনচারী মানুষ বাণের নিশানায় তাক করে ফেলল! এ আশ্চর্য, অত্যাশ্চর্য! একথা কোনমতেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না।’ বিলাপ করতে করতে মন্দোদরীর মনে অন্যভাবের উদয় হোল। যেহেতু তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, কোন মানুষ রাবণকে মারতেই পারে না, অতএব মানুষের রূপ ধরে যুদ্ধক্ষেত্রে কোন দেবতার আবির্ভাব হয়েছিল। কিন্তু দেবরাজ ইন্দ্রও যার সামনে দাঁড়াতে পারেন না, তাহলে সেই বীরপুঙ্গব লঙ্কেশ্বরকে মারল কে? নাঃ, এ কোন দেবতার কর্ম নয়। স্বয়ং যমরাজ অতর্কিত মায়া রচনা করে রামরূপে যুদ্ধক্ষেত্রে রাবণের বিনাশের জন্য অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তা না হলে রাবণকে মারল কে?
এই হল পতি গর্বে গরবিনী
মন্দোদরী – এ
হল তাঁর পাতিব্রত্যের দিক। রাবণ যতই দুরাচারী, কপটচারী ও নির্মম হোক মন্দোদরীর কাছে রাবণ শুধু
দেবতাই নয়, যে
কোন দেবতার থেকেও বড়। তাঁর পাতিব্রত্য প্রশংসনীয়। কিন্তু যেহেতু তিনি স্বর্গের
অপ্সরার কন্যা,
তাই তাঁর মধ্যে
ঐশীচেতনা সুপ্ত হলেও ছিল। আজ এই বিপর্যয়ের কালে তাঁর সেই সুপ্ত চেতনা জেগে উঠেছে। রাবণের
পরাজয়ের ও মৃত্যুর নানা প্রকার কারণ অনুসন্ধান ও অনুমান করতে করতে যখন
কোনটাই তাঁর মনঃপূত হল না, তখন
তিনি তাঁর কল্পনার
অন্তিম স্তরে পৌঁছুলেন। তিনি ভাবলেন, রাবণের থেকে, দেবতাদের
থেকে, মহর্ষি গন্ধর্বদের
থেকে বেশী শক্তিশালী হতে পারেন একমাত্র সনাতন পরমাত্মা। তাই তাঁর স্থির বিশ্বাস, এই রাম আর কেউ নয়, ইনি মহাযোগী সনাতন পুরুষ- পরমাত্মা,
যিনি সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের
কর্তা। ইনি অজ্ঞানান্ধকারের পারে অবস্থানকারী পরম জ্যোতির্ময়। ইনি
শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী, এঁর
বক্ষে শ্রীবৎস চিহ্ন, ভগবতী
লক্ষ্মী এঁর সদা সহচরী। ইনি চির অচঞ্চল ও সম্পূর্ণ লোকের অধীশ্বর। ভগবান বিষ্ণুই স্বয়ং ত্রিলোকের
কল্যাণ কামনায় মনুষ্যরূপে রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। আর
মানুষরূপী রামচন্দ্রের ঐ যে বানরসেনা, ওরা আসলে বানর নয়, বানররূপধারী দেবতা। ওদের সাহায্যেই
রামচন্দ্র আপনাকে
পরাস্ত ও বধ করেছেন। হে লঙ্কেশ্বর! এঁর কারণ আমি অনুমান করতে পারি, তা হল আপনি ছিলেন দেবশত্রু। শুধু তাই নয়,
আপনি ছিলেন সমগ্র জগতের
পক্ষে ভয়ঙ্কর।
তাই জগতের পালনকর্তা বিষ্ণুই তাঁর সৃষ্টি রক্ষার জন্য রাম নামক মানুষের
রূপে অবতীর্ণ হয়ে বানর রূপী দেবতাদের সাহায্যে আপনাকে বধ করে জগতকে কণ্টকমুক্ত
করলেন।
মন্দোদরী শোকাবেগে
আরো বলে চললেনঃ ‘ যখন
শুনলাম, জন্মস্থানে
বহু রাক্ষস পরিবৃত
থাকা সত্ত্বেও আপনার ভাই খর রামচন্দ্রের বাণে নিহত হয়েছেন, তখনই বুঝেছি, এ রাম কোন সাধারন মানুষ নয়। আবার যখন
শুনলাম, দেবতাদের
পক্ষেও দুষ্প্রবেশ্য
লঙ্কায় রামের দূত হনুমান প্রবেশ করেছে, তখনি অনিষ্ট আশঙ্কায় ব্যাথিত হয়েছিলাম। আপনার এই পরিণতি কেন
হল, একটু ভেবে দেখুন। আমি
আপনাকে রামের
সাথে বিরোধ করতে নিষেধ করেছিলাম। বলেছিলাম, ‘ক্রিয়তামবিরোধশ্চ রাঘবেন...’ (যুদ্ধ কাণ্ড ১১১ শ সর্গ, ১৮শ সংখ্যক শ্লোক) কিন্তু আপনি সেকথায় কর্ণপাত
করেননি। ‘উচ্যমানো
ন গৃহ্নাসি তস্যেয়ং ব্যুষ্টিমাগতা’ (যুদ্ধ কাণ্ড ১১১ শ সর্গ, ১৮শ সংখ্যক শ্লোক)। অহংকারই আপনার এই
পরিণতির কারণ। এবার মন্দোদরী সরাসরি রাবণকে আক্রমণ করলেন, পতি বলে আর খাতির নয় – রূঢ় ভাষায় দুর্মতি বলে সম্বোধন ক্রলেনঃ ... “দুর্মতে। সীতাং ধর্ষয়তা মান্যাং ত্বয়া হ্যসদৃশং
কৃতম্।।” অনন্য
পতিব্রতা, সর্বপূজ্যা
সীতাদেবীর অপমান করে আপনি ভয়ঙ্কর অন্যায় করেছেন। আপনার কামনা তো
পূরণ হয়ই নি, বরং
ঐ পতিব্রতা নারীর তপস্যার আগুনে আপনি পুড়ে ছাই হয়ে গেলেন! তাছাড়া, আপনার পরাজয় ও মৃত্যুর অন্য
কোন কারণ নেই। হে প্রভো! উপযুক্ত কালে পাপকারী ব্যক্তি পাপের ফল অবশ্যই
ভোগ করে।
এবার মন্দোদরী নিজের বংশমর্যাদা, রূপ ও গুণের কথা নিজমুখেই বলেছেনঃ
এবার মন্দোদরী নিজের বংশমর্যাদা, রূপ ও গুণের কথা নিজমুখেই বলেছেনঃ
“ন কুলেন ন রূপেণ এ
দাক্ষিণ্যেন মৈথিলী।
ময়াধিকা তুল্যা বা তৎ তু মোহান্ন বুধ্যসে।।” (যুদ্ধকাণ্ড ১১১শ সর্গ – ২৮ শ্লোক )
ময়াধিকা তুল্যা বা তৎ তু মোহান্ন বুধ্যসে।।” (যুদ্ধকাণ্ড ১১১শ সর্গ – ২৮ শ্লোক )
না বংশমর্যাদায়,
না রূপে বা
ঔদার্য্যাদিগুণে সীতা আমার থেকে বেশী তো নয়ই, আমার সমতুলও নয়। তথাপি, হে মোহান্ধ রাবণ! মোহের বশে আপনি তা
বুঝলেন না। এই শ্লোকে মন্দোদরীর আত্মপ্রশংসা করা বা সীতাকে হেয় করা উদ্দেশ্য
নয়, উদ্দেশ্য রাবণের
মোহান্ধতা ও মূর্খতাকে স্পষ্ট করা।
মন্দোদরী বলে চললেন,
‘আপনি সীতার মোহে
মৃত্যুকে দূর থেকে আহ্বান করে এনেছেন। সংসারে কোন ব্যাক্তির মৃত্যু অকারণে হয় না, আপনার মৃত্যুরও কারণ আছে – সীতাই আপনার মৃত্যুর কারণ। আমার খুব গর্ব ছিল
দানবরাজ ময় আমার বাবা, রাক্ষসেশ্বর
রাবণ আমার
স্বামী, দেবরাজ
ইন্দ্রজয়ী আমার পুত্র। (পিতা দানবরাজো মে ভর্তা রাক্ষসেশ্বরঃ পুত্রো মে শত্রুনির্জেতা
ইত্যহং গর্বিতা ভৃশম্) কিন্তু আপনিই আমার সে গর্ব চূর্ণ করে দিলেন। আজ আমি
বিধবা, যে
বৈধব্যের কথা স্বপ্নেও ভাবিনি। আপনি নিজের দোষে, সতীনারীর মর্যাদাহানির পাপে আমার জীবনে
এই স্বপ্নাতীত
বৈধব্য এনে দিলেন।’
রাবণ মন্দোদরীর প্রিয়
– এত প্রিয় যে, তিনি তাঁর(রাবণের) বিরহে বেঁচে থাকতেও
চান না। স্বতঃ পতির পাশে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘নয় মামপি দুঃখার্তাং ন বর্তিষ্যে ত্বয়া
বিনা।’ – দুঃখক্লিষ্ট
আমাকেও সঙ্গে নিয়ে চলুন। আপনাকে ছাড়া আমি বাঁচব না।
পতির প্রতি গভীর প্রেমবশতই রাবণের মৃত্যুর কারণগুলি তাঁর পাপকর্মগুলি মন্দোদরীর চেতনায় প্রতিফলিত হয়ে ফুটে উঠেছে। অকস্মাৎ দুঃসহ দুঃখের আঘাতে তাঁর সুপ্ত চেতনা, সুপ্ত বিবেক জেগে উঠেছে। সেই জাগ্রত চেতনার আলোকে তাঁর মাঝে মাঝে মোহমুক্তি ঘটেছে। নির্মোহ চৈতন্যজ্যোতিতে তিনি রাবণের অপকীর্তিগুলি, মহাপাপগুলি দেখতে পাচ্ছেন এবং বুঝতে পারছেন, এত বীর্যশালী, মহা ভয়ঙ্কর লোকরাবণ রাবণের মৃত্যুর কারণ। তাই এত গভীর শোকের মধ্যেও রাবণের পাপকর্মগুলি তুলে ধরেছেন। তাঁর মনে এক প্রবাদের কথা উদিত হয়েছেঃ
পতির প্রতি গভীর প্রেমবশতই রাবণের মৃত্যুর কারণগুলি তাঁর পাপকর্মগুলি মন্দোদরীর চেতনায় প্রতিফলিত হয়ে ফুটে উঠেছে। অকস্মাৎ দুঃসহ দুঃখের আঘাতে তাঁর সুপ্ত চেতনা, সুপ্ত বিবেক জেগে উঠেছে। সেই জাগ্রত চেতনার আলোকে তাঁর মাঝে মাঝে মোহমুক্তি ঘটেছে। নির্মোহ চৈতন্যজ্যোতিতে তিনি রাবণের অপকীর্তিগুলি, মহাপাপগুলি দেখতে পাচ্ছেন এবং বুঝতে পারছেন, এত বীর্যশালী, মহা ভয়ঙ্কর লোকরাবণ রাবণের মৃত্যুর কারণ। তাই এত গভীর শোকের মধ্যেও রাবণের পাপকর্মগুলি তুলে ধরেছেন। তাঁর মনে এক প্রবাদের কথা উদিত হয়েছেঃ
“প্রবাদঃ সত্যমেবায়ং
ত্বাং প্রতি প্রায়শো নৃপ।
পতিব্রতানাং নাকস্মাৎ পতন্ত্যশ্রূণি ভূতলে।।”
পতিব্রতানাং নাকস্মাৎ পতন্ত্যশ্রূণি ভূতলে।।”
হে রাজন! আপনার
ক্ষেত্রে এই প্রবাদ সত্য বলে প্রমাণিত হয় যে, পতিব্রতা নারীর অশ্রু ব্যর্থ হয় না। হায় মহাবীর!
পরস্ত্রী চুরি করার মত এত নীচ কাজ আপনি কি করে করলেন! লক্ষণকে দূরে সরিয়ে
দিয়ে একাকিনী অসহায় সীতাকে চুরি করতে গিয়ে আপনি কাপুরুষ হয়ে গিয়েছিলেন
এবং ঐ কাজ করার সময়ই আপনার মৃত্যু ঘণ্টা বেজে উঠেছিল।”
যে সত্যবাক্ বিভীষণের
কথা রাবণ কানে তোলেননি, আজ
তাঁর মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে মন্দোদরীর স্মৃতিপটে তাঁর কথা ফুটে উঠেছে। অপহৃতা সীতা
কে দেখেই বিভীষণ
দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে ব্লেছিলেনঃ প্রধান প্রধান রাক্ষসগণের বিনাশকাল উপস্থিত।
মন্দোদরী এবার তাঁর পাপের স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে তাঁর জন্য যে শোক করাও উচিৎ নয় সে কথা বলেছেনঃ
মন্দোদরী এবার তাঁর পাপের স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে তাঁর জন্য যে শোক করাও উচিৎ নয় সে কথা বলেছেনঃ
“ন হি ত্বং শোচিতব্যো
মে প্রখ্যাতবলপৌরুষঃ।
স্ত্রী স্বভাবাৎ তু মে বুদ্ধিঃ কারণ্যে পরিবর্ততে।।”
স্ত্রী স্বভাবাৎ তু মে বুদ্ধিঃ কারণ্যে পরিবর্ততে।।”
‘হে বলবীর্যখ্যাত
রাবণ! আপনি আমার শোকের যোগ্য নন, তথাপি
স্ত্রী স্বভাববশত আমার হৃদয় দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। আপনি ভাল মন্দ যে কর্ম করেছেন,
তার ফলস্বরূপ উপযুক্ত
গতি আপনার প্রাপ্ত হয়েছে। কিন্তু বৈধব্যহেতু আমি নিজের জন্য শোক করছি।’
রাবণের মৃত্যুর পর
মন্দোদরীর বিলাপের মধ্যেই তাঁর মহত্ত্ব ফুটে উঠেছে। পতি তাঁর প্রিয়, একথা অনস্বীকার্য তথাপি ঐ শোকের আবহে
তাঁর মুখ দিয়ে
বিদ্যুৎ ঝলকের মত যে সত্য ও শাশ্বত বাণীগুলি বেড়িয়ে এসেছে, তাতেই তাঁর চরিত্র মহিমান্বিত হয়েছে। ঐ ভয়ঙ্কর
শোকাবহ মুহূর্তে প্রাণপ্রিয় মৃতপতির সম্মুখে দাঁড়িয়ে তিনি
সদ্যঃপতিহন্তার স্তুতি করেছেন- তাঁকে নারায়ণ বলে চিনতে পেরেছেন -এটাই তাঁর মহত্ত্বের
শ্রেষ্ঠ পরিচয়। ভয়ঙ্কর সমরাঙ্গনে শোক সন্তপ্ত হৃদয়ে পতিহন্তার সম্পর্কে
তাঁর মন্তব্য আমাদের অভিভূত করেঃ
“ব্যক্তমেষ মহাযোগী
পরমাত্মা সনাতনঃ।
.............................................
তমসঃ পরমো ধাতা শঙ্খচক্রগদাধরঃ।।”
.............................................
তমসঃ পরমো ধাতা শঙ্খচক্রগদাধরঃ।।”
- স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে,
ইনি (রাবণের হত্যাকারী
শ্রীরামচন্দ্র) মহাযোগী সনাতন পরমাত্মা অজ্ঞানান্ধকারের পারে
অবস্থানকারী সর্বলোকের ধারক, শঙ্খচক্রগদাধারী
বিষ্ণু; সকলের
মঙ্গল কামনায় মানুষের রূপ ধারণ করে এসেছেন, ভয়ঙ্কর দেবশত্রুকে সপরিবারে বধ করার
উদ্দেশ্যে।
এখানে লক্ষ্য করার বিষয়,
রাবণ মন্দোদরীর এত
প্রিয় হওয়া সত্ত্বেও তিনি মোহান্ধতাবশত ঐ দুর্বিষহ শোকাবহ মুহূর্তেও তাঁর পতিহন্তার
বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করেননি, একটিও
কটু বাক্যও
উচ্চারন করেননি। বরং রাবণ তাঁর মৃত্যুর জন্য নিজেই দায়ী একথা বারবার বলেছেন
এবং সবশেষে তাঁকে ভয়ঙ্কর দেবশত্রু বলে উল্লেখ করে, দেবতার হাতে মৃত্যু অন্যায় কিছু নয়, একথাই বোঝাতে চেয়েছেন।
মন্দোদরীর অনেক গুণের কথাই আলচিত হল। এত গুণ সত্ত্বেও মন্দোদরীর একটি ত্রুটির কথা আমাদের নজরে আসে সেটি পরের পর্বে আলোচনা হবে
মন্দোদরীর অনেক গুণের কথাই আলচিত হল। এত গুণ সত্ত্বেও মন্দোদরীর একটি ত্রুটির কথা আমাদের নজরে আসে সেটি পরের পর্বে আলোচনা হবে
মন্দোদরীর অনেক গুণের
কথাই আলচিত হল। এত গুণ সত্ত্বেও মন্দোদরীর একটি ত্রুটির কথা আমাদের নজরে আসে। সেটি
হল, বিধবা মন্দোদরী তাঁর দেওর বিভীষণকে পতিত্বে বরণ
করেছিলেন। বর্তমান সামাজিক রীতি অনুযায়ী মন্দোদরীর এই ব্যবহার সমর্থন যোগ্য নয়,
বরং নিন্দনীয়। কিন্তু
পরাশর সংহিতায় বিধবা বিবাহের স্পষ্ট সমর্থন আছে। সুতরাং শুধু এই কারণে
মন্দোদরীকে অসতী বা নিন্দাভাজন বলা যায় না। অতএব পরাশর সংহিতার সমর্থনে,
আমরা মন্দোদরীর চরিত্রে
যে ত্রুটি লক্ষ করেছিলাম তা খণ্ডিত হল।
মনেরাখা দরকার, বাল্মীকি
রামায়নে বিধবা মন্দোদরীর দেওর বিভীষণকে পতিরূপে গ্রহণ করার উল্লেখ
নেই, আছে কৃত্তিবাসী রামায়নে। সেখানেও রামচন্দ্র স্বয়ং বিভীষণের হাতে মন্দোদরীকে সমর্পণ করেছেন। প্রথমত
পরাশর সংহিতার স্বীকৃতি। দ্বিতীয়ত বিবাহের
দোষে মন্দোদরীকে দুষ্ট বলা যায় না। তাছাড়া, মন্দোদরী স্বেচ্ছায় বিভীষণকে পতিরূপে গ্রহণ
করেননি। শ্রীরামচন্দ্রের আদেশে বিভীষণ লঙ্কার
সিংহাসনে অভিষিক্ত হওয়ার পর শ্রীরামচন্দ্র বিভীষণকে বলেনঃ
“মন্দোদরী লাগি
কিছু না ভাবিও মনে।
মন্দোদরী দিব তোমা মম অঙ্গীকার।।
রাজস্ত্রী রাজাতে লয় আছে ব্যবহার।
........................................
রানী মন্দোদরী তোমা দিলাম এখন।।” (কৃত্তিবাসী রামায়ণ – লঙ্কাকাণ্ড)
মন্দোদরী দিব তোমা মম অঙ্গীকার।।
রাজস্ত্রী রাজাতে লয় আছে ব্যবহার।
........................................
রানী মন্দোদরী তোমা দিলাম এখন।।” (কৃত্তিবাসী রামায়ণ – লঙ্কাকাণ্ড)
অতএব বিভীষণকে গ্রহণ
করার ব্যাপারে মন্দোদরীর কোন ভূমিকা নেই। শ্রীরামের আদেশই শিরোধার্য বলে ধরা হয়েছে। সুতরাং
মন্দোদরীকে এই ঘটনায় কোন প্রকারেই দায়ী বা দোষী করা যায় না। অতএব
মন্দোদরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ খণ্ডিত হওয়ার পর তাঁর পূর্ব আলচিত গুণাবলীর জন্যই তাঁকে
পাঁচজন পাপখণ্ডন কারিণী রমণীর অন্যতম বলা হয়েছে।
* সমাপ্ত *
No comments:
Post a Comment