আমরা মহাভারতের দ্রৌপদীর নাম সকলেই শুনেছি বা জেনেছি। অনেকে
তাঁর সম্পর্কে ভালো বলে, অনেকে খারাপ বলে। তবে বেশিরভাগ জনই তাঁকে মহিয়সী নারী
রুপেই দেখে। তাঁকে নারী প্রগতীর অগ্রদূতী বলা হয়। বর্তমান নারীদের কাছে তিনি একজন
আদর্শ নারী। কেন তিনি নারী প্রগতীর অগ্রদূতী, কেন তিনি আদর্শ নারী তা আমরা "চরৈবেতি",
বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনের সৌজন্যে দেখব।
নারী প্রগতির অগ্রদূতী দ্রৌপদী
লেখকঃ – চন্দ্রকিশোর তানেজা
একজন আধুনিকা এসে বললেন ‘আপনাদের ব্যাপার স্যাপার বুঝিনা ।’
লেখক বললেন কেন কি হয়েছে?
আধুনিকাঃ এই দেখুন না, আপনাদের শাস্ত্র বলছে অহল্যা, দৌপদী
ইত্যাদি কন্যার নাম স্মরণ করলে নাকি মহাপাপ নাশ হয়। এই বলে আধুনিকা গড় গড় করে
সংস্কৃত শ্লোক আউরে দিলেন-
‘অহল্যা, দ্রৌপদী,
কুন্তি, তারা মন্দোদরী তথা।
পঞ্চ কন্যাং স্মরেন্নিত্যং মহাপাতক নাশনম্ ।।’
লেখক
বললেন এতে না বোঝার কি আছে? আপনার আপত্তিই বা কোথায় ?
উনি
বললেনঃ আমাদের একটু বাঁকা চাউনিতেই ভাগবত অশুদ্ধ হয়ে যায়, আর অনারা হয়ে যায় প্রাতস্মরণীয়া।
এর কারণ টা কি?
লেখক
বললেনঃ কারণ অবশ্যই আছে। আপনার বক্তব্যটা একটু পরিষ্কার করে বলুন।
উনি বললেনঃ আমার বক্তব্য জলের মত পরিষ্কার।
আমাদের একটু বক্র কটাক্ষে আমরা অসতী, নষ্টা ইত্যাদি অপবাদে ভূষিত হই আর দ্রৌপদী
পাঁচ জন পুরুষকে নিয়ে ঘড় করলেন, আর উনি হলেন মহাপাপ নাশকারিণী নিত্য স্মরণীয়া –
কেন?
লেখকঃ
আপনারা ওপর ওপর ভাসেন ভিতরে ডোবেন না। তাই আপনাদের ধন্দ কাটে না। ধৈর্য ধরে শুনুন।
আশাকরি আপনার ধন্দ কেটে যাবে আর আপনিও দ্রৌপদীকে প্রাতস্মরণীয়া বলবেন।
প্রথমে
দ্রৌপদীর জন্মবৃত্তান্ত জানা দরকার। মহাভারত থেকে জানা যায় দ্রৌপদী সাধারন কন্যা
নন। সাধারন কন্যার মত তাঁর জন্মও হয়নি। তিনি অযোনিসম্ভবা। যজ্ঞবেদী থেকে তাঁর
জন্ম। তাই তিনি জন্মাবধি পবিত্র। জরায়ুর অপবিত্রতা তাকে স্পর্শ করেনি। এই হল
দ্রৌপদীর প্রাথমিক পরিচয়। তাঁর সম্বন্ধে বিশদভাবে জানতে গেলে মহাভারতের গভীরে
প্রবেশ করতে হবে। পাণ্ডবদ্বেষী দুর্যোধনের চক্রান্তে একবার মাতা কুন্তী সহ পঞ্চপাণ্ডবকে
বারণাবতনগরে পুরিয়ে মারার চেষ্টা করা হয়। পান্ডব হিতৈষী বিদুরের পরামর্শে ও
সাহায্যে তাঁরা কৌশলে সেখান থেকে পালিয়ে গেলেন। প্রাণভয়ে পালিয়ে তাঁরা গভীর
জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে তাঁরা পথ চলতে থাকে। পাছে কৌরবরা চিনতে পেরে পুনরায় ক্ষতি করে
দেয় সেই আশঙ্কায় তাঁরা ব্রাহ্মনের ছদ্মবেশ ধরে। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে পথে পিতামহ
ব্যাসদেবের সাথে দেখা হল। ব্যাসদেব তাদের একচক্রানগরে এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে থাকার
ব্যবস্থা করে দিলেন। পাণ্ডবগণ একচক্রানগরে দিনের বেলায় ব্রাহ্মণবেশে ভিক্ষা করে
ভিক্ষালব্ধ সামগ্রী মায়ের চরণে অর্পণ করতেন। মা সকলকে সমানভাবে ভাগ করে দিতেন।
এভাবে দিন কাটছিল। একদিন পাণ্ডবগণ লোকমুখে জানতে পারেলেন যে পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ
তাঁর কন্যা যাজ্ঞসেনীর (যজ্ঞ বেদী থেকে উদ্ভূতা বলে এই নাম) স্বয়ম্বর সভা আহ্বান
করেছেন। পাণ্ডবগণ সেই সভায় সমবেত হলেন। ঘটনাক্রমে ব্রাহ্মনবেশী অর্জুন দুরূহ
লক্ষভেদ করে কন্যাপণের শর্ত পূরণ করলে, পাঞ্চালরাজ তাঁর হাতে কন্যা সমর্পণ করেন। পান্ডবজননী
কুন্তী এসব কিছুই জানতেন না। তিনি কুটিরে একা ছিলেন। পুত্রদের ভিক্ষা থেকে ফিরতে
দেরি দেখে তাঁর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ছিল।
গোধূলি বেলায় ছোট কুটির আলোআবছা হয়ে এল। এমত সময়ে ভীম-অর্জুন বাইরে থেকে ডেকে
বললেন, ‘মা দেখ, আজ ভিক্ষায় এক অপূর্ব জিনিস পেয়েছি ।’ পুত্রদের কণ্ঠস্বর শুনে মা
কুটিরের ভিতর থেকেই কিছু না দেখে উত্তর দিলেন, যা এনেছ, পাঁচজন মিলে ভোগ কর। [‘কুটীগতা
সা ত্বনবেক্ষ্য পুত্রৌ প্রোবাচ ভুঙ্ ক্তেতি সমেত্য সর্বে।’ – উপরের বাক্যটি
ব্যাসদেবের মহাভারতের উল্লিখিত এই বাক্যের অনুবাদ ।] কুন্তী কুটিরে থাকায় পুত্রদের
দেখতে পাননি। না দেখে তিনি যা আদেশ দিলেন তারই পরিণতিতে দ্রৌপদীর পঞ্চপতি।
এ
খবর জানতে পেরে দ্রৌপদীর বাবা রাজা দ্রুপদ এই অশাস্ত্রীয় বিয়েতে আপত্তি জানালেন।
স্বয়ম্বর উপলক্ষে অনেক মুনি-ঋষি দ্রুপদ রাজ্যসভায় উপস্থিত ছিলেন। দ্রুপদের আপত্তি
শুনে ব্যাসদেব বললেন, ‘দ্রৌপদীর পঞ্চপতি বিধিনির্দিষ্ট।’ এই বলে তিনি পুরাণের গল্প
শোনালেন – ত্রেতাযুগে দ্রৌপদী ব্রাহ্মণকন্যা ছিলেন। সেই জন্মে তিনি পতি কামনায়
ভক্তিভরে নিত্য শিবপুজা করতেন । মাটির শিবলিঙ্গ তৈরি করে পুস্প, ঘী, মধু ইত্যাদি
পঞ্চপচারে বাজনা বাজিয়ে তাঁর পুজো করতেন। পুজো শেষে, ‘পতিং দেহি, পতিং দেহি’ এভাবে
পাঁচবার পতি প্রার্থনা করতেন। দীর্ঘকাল শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠা সহকারে দেবাদিদেবের পুজো
করার ফলে দেবাদিদেব সন্তুষ্ট হয়ে মহাদেব স্বয়ং আবির্ভূত হলেন। ব্রাহ্মণ কন্যাকে
দেখা দিয়ে বললেনঃ ‘কন্যে, আমি তোর পুজোয় সন্তুষ্ট হয়েছি। আমার বরে তোর পরম সুন্দর
পাঁচজন পতি হবে।’
শিবের
কাছ থেকে এই অদ্ভুত বর পেয়ে কন্যা চমকে ওঠেন এবং বলেন, ‘হে শূলপাণি, তুমি আমাকে ঠাট্টা
করছো কেন? বেদবিধি বহির্ভূত এ কোন বর দিচ্ছ ?’ মহাদেব স্মিতহেসে বললেন, ‘কন্যে,
এতে আমার দোষ কোথায়? ভেবে দেখ তুই পাঁচবার “পতিং দেহি” বলেছিস। যতবার বলেছিস ততবার
একজন করে পতি দিয়েছি। অতএব পঞ্চপতি তোরই চাওয়া। যা চেয়েছিস, তাই পেয়েছিস ।’ – এই
বলে মহাদেব অন্তর্হিত হলেন। কন্যা মনো দুঃখে গঙ্গাজলে দেহ বিসর্জন দিলেন।
ব্যাসদেব
বলে চললেন, ‘সেই কন্যা পরজন্মে কাশীর রাজ বাড়িতে জন্মগ্রহণ করলেন। যৌবনে বর না
জুটায় আত্মগ্লানিতে তিনি কঠোর তপশ্চর্যায় রত হলেন। হিমালয় পর্বতে তাঁর সুকঠোর
তপস্যায় দেবগণ মুগ্ধ হয়ে তাঁর সামনে আবির্ভূত হলেন। ধর্ম, ইন্দ্র, পবন ও
অশ্বিনীকুমারদ্বয় সমবেত ভাবে বললেন, ‘সুন্দরী, তুমিতো পতিলাভের আশায় এত কঠোর
তপস্যা করছ ? তাই যদি হয়, তুমি আমাদের এই পাঁচজনের মধ্যে থেকে যাকে ইচ্ছা বেছে নাও
।’ একথা শুনে কন্যা পাঁচজনের মুখপানে চাইলেন। দেখলেন, সকলেই অনিন্দ সুন্দর , কেও
কারোর থেকে কমা নয়। পাঁচজনের রূপে মুগ্ধ কন্যা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চুপ করে দাড়িয়ে
রইলেন। পাঁচজন দেবতা তখন কন্যার মনোভাব বুঝতে পেরে বললেন, ‘এ জন্মে তোমার কিছু হবে
না। তাই এ দেহ তুমি ত্যাগ কর। পরজন্মে এই পাঁচজনকেই পতিরূপে পাবে ।’ দেবগণ
অন্তর্নিহিত হলে ঐ কাশীরাজকন্যা তপস্যার দ্বারা দেহ ত্যাগ করলেন।
গল্প
শেষ করে ব্যাসদেব বললেন, ‘হে দ্রুপদরাজ! সেই কন্যা আজ আপনার ঘরে দ্রৌপদী হয়ে
জন্মেছেন। ধর্ম, ইন্দ্র, পবন ও অশ্বিনীকুমারদ্বয় দ্রৌপদীর পতি হওয়ার জন্য যথাক্রমে
যুধিষ্ঠির, অর্জুন, ভীম, নকুল ও সহদেব নামে জন্মেছেন। অতএব, বুঝতে পারছেন মহারাজ!
দ্রৌপদীর পঞ্চপতি বিধিনির্দিষ্ট। এর অন্যথা হওয়ার উপায় নেই ।’ এরপর অগস্ত্যমুনি
বললেন, ‘দ্রৌপদীর পঞ্চপতিত্ব যেমন দেবতাদের বরের ফল, তেমনি সুরভি নামক গাভীর
অভিশাপেরও ফল ।’ এই রকম আলাপ আলোচনা যখন চলছে, তখন পান্ডব জননী কুন্তী অন্দরমহল থেকে
বেড়িয়ে এলেন। তিনি মহর্ষি দ্বৈপায়নের পাদবন্দনা করে সকাতরে বলতে লাগলেন, -
‘আমারে
নিস্তার করো মিথ্যা বাক্যে ভয় ।’ – কাশীদাসী মহাভারত
কুন্তীর
মিথ্যা বাক্য কি? কুন্তিদেবী অসাবধানতবশত যে বাক্য বলেছিলেন; তা কার্যে পরিণত না
হলেই তিনি মিথ্যাবাদীনী হয়ে যাবেন। ব্যাসদেব রচিত মহাভারত থেকে জানা যায়-
‘কুটীগতা সা ত্বনবেক্ষ্য পুত্রৌ প্রোবাচ ভুঙ্ ক্তেতি সমেত্য
সর্বে ।
পশ্চাচ্চ কুন্তী প্রসমীক্ষ্য কৃষ্ণাং কষ্টং ময়াভাষিতমিত্যুবাচ
।।
অর্থাৎ
কুন্তীদেবী কুটিরের ভিতরে থেকেই পুত্রদ্বয় (ভীম ও অর্জুন) কে বললেন, ‘তোমরা সকলে
মিলে ভোগ কর পরে কৃষ্ণাকে দেখে বললেন, হায় আমি দুঃখদায়ক কথা বলে ফেললাম ।’ এ বলে কুন্তীদেবী দুঃখ প্রকাশ করতে লাগলেন।
এরপর
তিনি পুত্র যুধিষ্ঠির কে বললেন, ‘পুত্র, তুমি কৌরব-পান্ডবগণের মধ্যে জ্যেষ্ঠ এবং
ধর্ম জ্ঞানে শ্রেষ্ঠ । তুমিই বল আমার সত্যরক্ষা কিভাবে হয় ।’
‘ময়া কথং নানৃতমুক্তমদ্য ভবেৎ কুরূণামৃষভো ব্রবীহি ।
পাঞ্চালরাজস্য সুতামধর্মোনোপবর্তেত ন বিভ্রমেচ্চ ।।’
শুধু
নিজের সত্য রক্ষার জন্যই তিনি চিন্তিত ছিলেন না, দ্রুপদ কন্যা পাঞ্চালীর যেন অধর্ম
না হয়, তিনি যেন বিভ্রান্ত না হয়ে পরেন, সেদিকেও তাঁর চিন্তা ছিল।
মায়ের
এই কথা শুনে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির কিছুক্ষণ চিন্তা করে মাকে তাঁর সমস্যা সমাধানের
আশ্বাস দিলেন। তারপর অর্জুনকে বললেন, ‘ভাই তুমিই তো যাজ্ঞসেনীকে জয় করেছ। তাই
তোমারই প্রাপ্য এই রাজকন্যা। তোমার সঙ্গে মানাবেও ভালো। অতএব যথোচিত অগ্নিসাক্ষী
করে তুমিই পাঞ্চালীকে গ্রহণ কর ।’
অর্জুন
এ প্রস্তাবে রাজি হলেন না। অর্জুন বললেন, ‘হে নরশ্রেষ্ঠ, আপনি আমাকে অধর্মভাগী
করবেন না। জ্যেষ্ঠ বর্তমানে অন্যের বিবাহ অশাস্ত্রীয় । সবার আগে আপনি যা আদেশ
করবেন তাই হবে। আমরা সকলেই আপনার শাসনের অধীন।’ অর্জুনের একথা শুনে পান্ডুপুত্রগন
সকলে দ্রৌপদীর দিকে তাকালেন। তাঁরা দ্রৌপদীর রূপ-লাবন্যে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তাঁদের
সকলেরই মনে হল – ‘কাম্যং রূপং পাঞ্চাল্যা বিধাত্রা বিহিতং স্বয়ম্ ।’ – (ব্যাস-মহাভারত)।
অর্থাৎ কামনা উদ্রেগকারী পাঞ্চালীর এই রূপ বিধাতা নিজহাতে নির্মাণ করেছেন।
যুধিষ্ঠির স্থিতধী। ভাইদের আকার ইঙ্গিত দেখে তাঁদের মনোভাব বুঝে নিলেন। তিনি
দূরদর্শী। তাই তাঁর বুঝতে অসুবিধা হল না, দ্রৌপদীকে কোন এক ভাই বিয়ে করলে
ভাতৃবিরোধ অবশ্যম্ভাবী । মহামুনি ব্যাসদেবের কথাও তাঁর মনে পরে গেল। ব্যাসদেব
বলেছিলেন, দ্রৌপদীর পঞ্চপতি বিধিনির্দিষ্ট। অতএব সবদিক বিবেচনা করে, সর্বপরি ভায়ে
ভায়ে বিরোধ পরিহারের উদ্দেশ্যে মতিমান যুধিষ্ঠির আদেশ দিলেন- ‘সর্বেষাং দ্রৌপদী
ভার্যা ভবিষ্যতি হি নঃ শুভা ।’ -(ব্যাস-মহাভারত)। দ্রৌপদী আমাদের সকলের ভার্যা
হবে। এতে আমাদের মঙ্গল। এভাবে দ্রৌপদীর পঞ্চপতিত্বের অনেকগুলি কারণ মহাভারত থেকেই
পাওয়া গেল। যথাঃ
১)
পূর্বজন্মে দ্রৌপদীর অসতর্ক প্রার্থনার ফলে শিবের দেওয়া বর। ২) পরবর্তী দ্বিতীয়
জন্মে কাশীরাজ কন্যা রূপে হিমালয়ে তপস্যার ফলে তুষ্ট ইন্দ্রাদি পঞ্চদেবতার বর। ৩)
সুরভি নামক গাভীর অভিশাপের। ৪) পান্ডব জননী কুন্তীর অসতর্ক নির্দেশ। ৫) দ্রৌপদীর
রূপ-লাবন্যে মুগ্ধ পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে বিরোধ পরিহারের কারণে যুধিষ্ঠিরের নির্দেশ।
অন্তিম কারণটিই মুখ্য এবং সর্বজনগ্রাহ্য।
সমস্ত
কারণগুলি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করলে, পঞ্চ পতিত্বের জন্যে দ্রৌপদীকে
কোনভাবেই দায়ী করা যায়না এবং একারণেই দ্রৌপদী এ বিষয়ে নির্দোষ। আধুনিকা এ পর্যন্ত
শুনে বললেন, ‘এত কথা তো জানতাম না।’ লেখক বললেন ‘আর একটা কথাও অনুধাবন করার মত; ঐ
পাঁচ জন (পঞ্চপাণ্ডব) ব্যাতীত রমণীললামভূতা দ্রৌপদী কখনো অন্য কোন পুরুষ কে মনে
জায়গা দেয়নি, যদিও তাকে পথভ্রষ্ট করার মত প্রলোভনের কোন অভাব ছিল না দ্রৌপদী
সুন্দরী, তেজস্বিনী, ওজস্বী, বাগ্মী এ কারণে দ্রৌপদী অনেক রাজা–রাজপুত্রের
চিত্তহারিণী অনেক রাজাই তাঁকে অঙ্কশায়িনী করতে চেয়েছেন। সতীত্বে অটল দ্রৌপদী তাদের
দিক থেকে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। বহু সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দ্রৌপদীর বিন্দু
মাত্র পদস্খলন ঘটেনি তাই তিনি শুধু সতী নন সতীদের অগ্রগন্যা।’
আধুনিকা
উৎসুক হয়ে বললেন- খুব ভাল লাগছে, দ্রৌপদী সম্বন্ধে আরো কি জানার আছে বলুন। লেখক
বললেনঃ এবার একটু পিছন ফিরে দেখা যাক। পাঞ্চালরাজ দরবারে দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায় উপস্থিত
ছিলেন কৃষ্ণ-বলরাম দুই ভাই। ব্রাহ্মণবেশী যুবককে লক্ষ্যভেদে সফল হতে দেখে
শ্রীকৃষ্ণের মনে দৃঢ় ধারনা হল, ঐ যুবক অর্জুন ছাড়া আর কেউ নন। এদিকে দ্রৌপদীকে
ব্রাহ্মণের গলায় মালা পরাতে দেখে সভায় তুমুল কোলাহল উঠল। ক্ষত্রিয় রাজন্যবর্গ
পাঞ্চালরাজ দ্রুপদকে প্রবঞ্চক বলে বিদ্রোহ করলেন। তাঁরা দাবি করলেন, ক্ষত্রিয়রাজা
ব্রাহ্মণকে কন্যা দিতে পারবেন না। এরকম অবস্থায় শ্রীকৃষ্ণ এই বলে রাজন্যবর্গকে
অনুরোধ করলেন, ‘ব্রাহ্মণ তো ধর্মের দ্বারাই কৃষ্ণাকে (দ্রৌপদীকে) লাভ করেছে, অতএব
আপনারা নিরস্ত হন।’
এরপর
কৃষ্ণ-বলরাম অলক্ষ্যে পাণ্ডবদের অনুসরণ করে ভার্গব কর্মশালায় (পাঞ্চালরাজ্যে এসে
পান্ডবগন এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন) প্রবেশ করলেন। এখানেই পাণ্ডবদের সাথে শ্রীকৃষ্ণের
প্রথম পরিচয়। দ্রৌপদীকে নিয়ে পাণ্ডবগণ মাতা কুন্তীসহ ভার্গবগৃহে সংসার পাতলেন।
এখবর অচিরে কৌরবরাজ ধৃতরাষ্ট্রের কানে পৌঁছুল। ধৃতরাষ্ট্রের ভীম ও বিদুরের সাথে পরামর্শ
করে পাণ্ডবদের যথাযোগ্য মর্যাদায় ফিরিয়ে আনলেন। ভবিষ্যৎ বিরোধ পরিহারের উদ্দেশ্যে
অন্ধ্ররাজ পাণ্ডবদের জন্য রাজ্য ভাগ করে ইন্দ্রপ্রস্থ নামক স্থানে রাজধানী স্থাপন
করে স্বাধীন ভাবে বাস করার অনুমতি দিলেন।
দ্রৌপদীর কপালে এত সুখ সইল না। ইন্দ্রপ্রস্থে গিয়ে দৌপদীর
নতুন দুঃখের সুত্রপাত হল। ইন্দ্রপ্রস্থে রাজধানী স্থাপন করার পর শ্রীকৃষ্ণের
পরামর্শে যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেন। যজ্ঞের প্রস্তুতির জন্য শ্রীকৃষ্ণ,
ময়দানব বিশ্বকর্মাকে এক চোখ ধাঁদানো অতি মনোরম অট্টালিকা নির্মাণ করে দিতে বললেন।
ময়দানব অনতিবিলম্বে যুধিষ্ঠিরের জন্য এক অদৃষ্টপূর্ব রমণীয় প্রাসাদ তৈরী করে
দিলেন। যজ্ঞে আমন্ত্রিত দুর্যোধন নানাভাবে অপদস্থ ও অপমানিত বোধ করলেন। বিশেষত
পাণ্ডবদের ঐশ্বর্য ও শ্রীবৃদ্ধি দেখে ঈর্ষায় জর্জরিত হলেন। পাণ্ডবদের সোপার্জিত
ধনসম্পদ থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে মামা শকুনির পরামর্শে যুধিষ্ঠিরকে পাশা খেলায়
আমন্ত্রণ জানালেন। কপট পাশা খেলায় যুধিষ্ঠির সর্বস্ব হেরে, নিজেকে পণ রেখেও হেরে
গেলেন। অবশেষে শকুনির প্ররোচনায় পত্নী দ্রৌপদীকে পণ রেখেও হেরে গেলেন।
দুর্যোধন আদেশ দিলেন ‘দ্রৌপদীকে এক্ষুনি এখানে নিয়ে আসা
হোক্।’ দ্রৌপদীর জীবনে এটিই চরম পরীক্ষার ক্ষেত্র। এখানেই দ্রৌপদীর তেজস্বিতা,
ওজস্বীতা ও বুদ্ধিমত্তা পূর্ণ রূপে ফুটে উঠেছে।
প্রাতিকামীকে দুর্যোধন পাঠালেন ইন্দ্রপ্রস্থে। বললেন, ‘যাও,
দ্রৌপদীকে এখানে নিয়ে এস। সে এখানে এসে পরিচারিকার যা কাজ তাই করুক। কেননা, সে এখন
আমাদের দাসী।’
প্রাতিকামী (সঞ্জয়ের পুত্র) ইন্দ্রপ্রস্থে দ্রৌপদীর কাছে
গিয়ে দুর্যোধনের আদেশ জানালেন। দ্রৌপদী আকাশ থেকে পড়লেন। প্রাতিকামী কে বললেন, ‘কি
হয়েছে বলো।’ প্রাতিকামী সসভ্রমে উত্তর দিল, ‘দেবী সর্বনাশ হয়েছে। রাজা যুধিষ্ঠির
পাশা খেলায় সর্বস্ব হেরে, নিজেকেও পণ রেখে হেরে গেছেন। অবশেষে আপনাকে পণ রেখেও
হেরে গেছেন। ফলে দুর্যোধন আপনাকে জিতে নিয়েছে। তাই দুর্যোধন আপনাকে হস্তিনাপুরে
নিয়ে যেতে বলেছেন দাসীর কাজ করার জন্য।’
এরকম এক অকল্পনীয় ঘটনার কথা শুনে দ্রৌপদী কিংকর্তব্যবিমূঢ়
হলেন না, বা ‘হায় হায়’ বলে কপাল চাপড়াতে লাগলেন না, বরং তিনি আহত সিংহীর মত
দৃপ্তকন্ঠে বললেন, ‘হে প্রাতিকামী, তুমি এ কি বলছ ! কোন রাজপুত্র কি স্ত্রীকে পণ
রেখে খেলে? মূর্খ রাজা পাশা খেলায় এমনই মেতে উঠল ! তার পণ ধরার অন্য কিছু ছিল না?’
উত্তরে প্রাতিকামী জানাল, ‘না, দেবী, তাঁর আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। রাজা
(যুধিষ্ঠির) আগে ভাইদের পণ রেখেছেন, তারপর নিজেকে এবং সব শেষে আপনাকে পণ রেখেছেন।’
এখথা শুনে প্রত্যুৎপন্নমতি দ্রৌপদী প্রাতিকামীকে বললেন, ‘সভায় গিয়ে পাশাখেলায় মত্ত
রাজাকে জিজ্ঞাসা কর – কে আগে হেরেছে? আগে আমি হেরেছি না আগে রাজা ? একথার উত্তর
ঠিকভাবে জেনে এসে আমাকে নিয়ে চল। রাজার (যুধিষ্ঠিরের) অভিপ্রায় জেনেই, আমি দুঃখিত
হলেও তোমার সাথে যাব ।’
প্রাতিকামী রাজসভায় গিয়ে দ্রৌপদীর অভীস্পিত প্রশ্ন রাজা
যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসা করল আরো স্পষ্ট ভাষায়। প্রাতিকামী বলল- ‘দ্রৌপদী জানতে
চেয়েছেন, আপনি কার মালিক – আপনি যে আমাকে বা আমাদের সকলকে বাজি রেখে হেরেছেন,
আমাদের ওপর আপনার কি প্রভুত্ব ছিল?’ – ‘কস্যেশো নঃ পরাজৈষীরিতি ত্বামাহ দ্রৌপদী।
কিন্নু পূর্বং পরাজৈষীরাত্মানমথবাহপি মাম্ ।।’ – (ব্যাস মহাভারত) এর অর্থঃ আপনি কি
অধিকারে আমাদের বাজী ধরে খেলেছেন? আপনি কি নিজে আগে হেরেছেন, না আমাকে আগে
হেরেছেন? এই প্রশ্নের মধ্যে দ্রৌপদীর সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের
পরিচয় ফুটে ওঠে। এই প্রশ্নের মধ্যে দ্রৌপদীর স্পষ্ট ইঙ্গিত, রাজা যদি আগে হেরে
গিয়ে থাকেন, তাহলে তাঁর আর কোন ব্যাক্তি বা বস্তুর উপর অধিকার থাকতে পারে না। সুতরাং
পরাজিত রাজার পক্ষে তাঁর স্ত্রী কে পণ ধরার কোন অধিকারই থাকে না। ফলে দ্রৌপদীকে
হারার বা জেতার কোন প্রশ্নই ওঠেনা। সেক্ষেত্রে প্রাতিকামী দ্রৌপদীকে দুর্যোধনের
কাছে নিয়ে যেতে পারে না। প্রশ্ন শুনে যুধিষ্ঠির প্রাণহীন অচেতনের মত নিশ্চেষ্ট হয়ে
বসে রইলেন। তিনি ভাল মন্দ কোন উত্তরই দিলেন না। সুযোগ বুঝে দুর্যোধন আদেশ দিলেন, -
‘এখানে এসেই দ্রৌপদী এই প্রশ্ন করুক। এখানেই সভাসদেরা তাঁর (দ্রৌপদী) এবং এর
(যুধিষ্ঠির) বক্তব্য শুনুন।’
এরপর প্রাতিকামী ব্যাথিত হৃদয়ে দ্রৌপদীকে দুর্যোধনের আদেশের
কথা জানাল। দ্রৌপদী উত্তরে জানালেন, ‘বিধাতার বিধান তো মানতেই হবে। তবু লোক বলে
-ধর্মই শ্রেষ্ঠ। ধর্ম রক্ষিত হলে শান্তি লাভ করা যায়। সেই ধর্ম যেন কৌরবদের ত্যাগ
না করে। হে প্রাতিকামী, তুমি সভায় গিয়ে সভ্যগণকে আমার ধর্মসমন্বিত এই কথা বল। সভায়
উপস্থিত বয়োজ্যেষ্ঠ ধর্মাত্মা ও নীতিনিষ্ঠ সভাসদেরা আমাকে নিশ্চিত করে তাঁদের মত
জানান। তাঁদের সুচিন্তিত সুনিশ্চিত মতই আমি পালন করব।’ আশ্চর্যের কথা, প্রাতিকামী
যখন সভায় গিয়ে দ্রৌপদীর ধর্মসম্মত কথা জানাল, তখন সভাসদ্গন দুর্যোধনের অভিপ্রায়
বুঝে হেঁটমুন্ডে নিরুত্তর হয়ে বসে রইলেন। যুধিষ্ঠির দূতকে (প্রাতিকামীকে) এই বলে দ্রৌপদীর
কাছে পাঠালেন যে, দ্রৌপদী যে অবস্থাতেই থাকুন তিনি শ্বশুরে সামনে দাঁড়ান।
যুধিষ্ঠির বললেন-
একবস্ত্রা
ত্বধোনীবী রোদমানা রজঃস্বলা ।
সভামাগত্য পাঞ্চালী
শ্বশুরস্যাগ্রতো ভব ।।
এর বাংলা করলে দাঁড়ায়- হে পাঞ্চালী, তুমি রজঃস্বলা হও বা
একবস্ত্রে থাক, অথবা তোমার ঘাগরার কোমরবন্ধ আলগা হয়ে ঝুলে পড়ুক, তুমি কাঁদতে থাক
বা আর যাই কর সভায় এসে শ্বশুরের সামনে দাঁড়াও।
এমত অবস্থায় দুর্যোধন প্রাতীকামীকে আদেশ দিলেন- ‘এখানেই
দ্রৌপদীকে নিয়ে এস।’ প্রাতীকামী দূত দুর্যোধনের বাধ্যতাহেতু তাঁর আদেশ পালনে তৎপর
হলেও দ্রৌপদীর ক্রোধের ভয়ে ভিত হয়ে সভ্যগণ কে আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘আমি দ্রৌপদীকে
গিয়ে কি বলব?’ একথার উত্তর না দিয়ে দুর্যোধন ভাই দুঃশাসনকে ডেকে বললেন, ‘এই মূর্খ
অর্বাচীন ভীমকে ভয় পাচ্ছে। দ্রৌপদীকে আনা অর কর্ম নয়। তুমি নিজে গিয়ে তাকে ধরে
নিয়ে এস ।’ এরপর যা ঘটল, পৃথিবীতে এতবড় পাপ বোধহয় এর আগে কখনো ঘটেনি। অনেক রক্তপাত
হয়েছে, অনেক নরহত্যা, ভাতৃহত্যাও ঘটেছে, কিন্তু নারীর এতবড় অপমানের সাক্ষ্য
পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোথাও নেই।
দুঃশাসন সরাসরি দ্রৌপদীর কাছে গিয়ে তাঁকে কর্কশ ও শ্রুতিকটু
ভাষায় জানল, ‘কৃষ্ণা, দুর্যোধন তোমাকে পাশাখেলায় জিতেছেন। তুমি এখন দুর্যোধনের
দিকে দৃষ্টিপাত করো। আর লজ্জা কিসের !’ একথা শুনে দ্রৌপদী যেখানে কুরুগৌরববৃদ্ধ
রাজাদের স্ত্রীগণ ছিলেন, সেদিকে ছুটে গেলেন। দুঃশাসনও ক্রোধে গর্জন করতে করতে তাঁকে অনুসরণ করল। তাঁর নীল
কুঞ্চিত কেশদাম ধরে টানতে লাগল। ‘দীর্ঘেষু নীলেষথ চর্মিৎসু জগ্রাহ কেশেষু
নরেন্দ্রপত্নীম্ ।’ - ব্যাসদেব মহাভারতে দুঃশাসন কর্তৃক দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণের কথা
ঐ শ্লোকার্ধে বর্ণনা করে তাঁকে কিভাবে সভায় নিয়ে যাওয়া হল তারও এক করুণ
মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিয়েছেন।
স তাং পরাকৃষয়
সভাসমীপমানীয় কৃষ্ণামাতিদীর্ঘকেশীম্ ।
দুঃশাসনো নাথবতীমনাথবচ্চকর্ষ
কদলীমিতাবার্তাম্ ।।
দুরাত্মা দুঃশাসন কৃষ্ণার চুলের মুঠি ধরে টানতে লাগল। যদিও
কৃষ্ণার পাঁচজন নাথ(পতি) বর্তমান, তথাপি
তাঁকে অসহায় (অ-নাথ) এর মত টানতে টানতে সভার কাছে আনা হল। সেই অসহায় কৃষ্ণা
ক্রোধে, লজ্জায়, অপমানে, ঝরের দাপটে অসহায় কলা গাছের মত কাঁপতে লাগলেন।
সভার কাছাকাছি যখন এসে পরেছেন, তখন দ্রৌপদী লজ্জায় আরও
বিব্রত হয়ে পড়লেন। তিনি ব্যাকুলভাবে করুণস্বরে আবেদন জানালেনঃ ‘আমি রজঃস্বলা,
একবস্ত্রে আছি। মূর্খ তুমি আমাকে সভায় নিয়ে যেওনা।’ দ্রৌপদীর করুণ আর্তির উপরে
নরপশু দুঃশাসন যা জানাল, তা সর্বকালের, সর্বদেশের অশ্রাব্য, জঘন্য, গর্হিত অপরাধ,
তা সকল নারীজাতির লজ্জার, বেদনার ও ক্ষোভের কারণ। গর্বান্ধ, মোহান্ধ ও বিজয়োল্লাসে
মত্ত দুঃশাসন বলল, ‘তুমি রজঃস্বলা, কি একবস্ত্রা বা বিবস্ত্রা- ওসব কাঁদুনি আমি
শুনতে চাইনা। পাশাখেলায় তোমাকে আমরা
জিতেছি। এখন তুমি আমাদের দাসী। দাসীর মত ব্যাবহারই তোমার প্রাপ্য।’ এই বলে দুঃশাসন
হিড়্ হিড়্ করে টেনে নিয়ে চলল। নির্মম ভাবে টানার ফলে তাঁর লম্বাচুলের গোছা
এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে পড়ল, পড়নের আধখানা কাপড় খুলে মাটিতে লুটোতে লাগল। রাগে জ্বলে
গেলেও লজ্জাবতী দ্রৌপদী সংযম অবলম্বন করে শান্তকন্ঠে বললেনঃ ‘এই সভায় গুরুজনগনের
সম্মুখে আমি এভাবে নিজেকে উপস্থাপিত করার
সাহস পাচ্ছি না।’ দুঃশাসনকে অনেক কাকুতি মিনতি করলেন, যাতে সে যেন তাঁর আব্রু
রক্ষা করে। কিন্তু দুঃশাসন সাধ্বীর কোন কথায় শুনল না। লজ্জায় কুঁকড়ে যাওয়া
দ্রুপদরাজকন্যাকে যখন টেনে হিঁচড়ে সভার সামনে হাজির করানো হল, বীরাঙ্গনা দ্রৌপদী
তখন আর ক্ষোভ চেপে রাখতে পারলেন না। রাজ্যসভার সামনে তিনি ক্ষোভে ফেটে পড়লেন।
সভাসদ্গণের উদ্দেশ্যে বললেনঃ
‘ধিগস্তু নষ্টঃ খলু
ভারতানাং ধর্মস্তথা ক্ষত্রবিদঞ্চ বৃত্তম্ ।
যত্র হ্যতীতাং
কুরুধর্মবেলাং প্রেক্ষন্তি সর্বে কুরবঃ সভায়াম্ ।।
দ্রোণস্য ভীষ্মস্য
চ নাস্তি সত্ত্বং ক্ষত্তুস্তথৈবাস্য মহাত্মনোহপি ।
রাজ্ঞস্তথা
হীমমধর্মমুগ্রং ন লক্ষয়ন্তে কুরুবৃদ্ধমুখ্যাঃ ।।
সহজ বাংলায় দ্রৌপদীর কথা এই ভাবে অনুবাদ করা যায়ঃ ধিক্ !
ধিক্ ! ভারতবর্ষের ধর্ম ধ্বংস হয়ে গেল। দুর্বল ও আর্তকে রক্ষা করা যে
ক্ষত্রিয়ধর্ম, তাও আজ শেষ। কেননা, সভায় উপস্থিত কুরুবংশীয় ক্ষত্রিয়গণ বিনা
প্রতিবাদে ধর্মের এই ভয়ানক গ্লানি দেখেছেন। এরপর মুখ্য সভাসদ্গণের নাম উল্লেখ করে
বললেন, দ্রোণ, ভীম, মহাত্মা বিদুর এদের কোন ক্ষমতাই নেই। এমনকি, রাজা
ধৃতরাষ্ট্রেরও কোন ক্ষমতা নেই। থাকলে এই উগ্র অধর্ম তাদের নজরে এরিয়ে যেতনা।
ভরা রাজসভায় এভাবে প্রতিবাদ জানানো সাহসিকতা দ্রৌপদী
চরিত্রের এক উজ্জল দিক। শুধু প্রতিবাদ জানিয়েই ক্ষান্ত হননি, তিনি নাম উল্লেখ করে
প্রত্যেকের দুর্বলতার দিকে আঙুল তুলেছেন। তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ করেছেন-
তাঁরা শুধুই বরিষ্ঠ সভাসদ্, তাদের ধর্মরক্ষা করার ক্ষমতা নেই। এমনকি রাজাকেও তিনি
ক্ষমতাহীন কাঠের পুতুল বলেছেন। তাঁর বলিষ্ঠ প্রতিবাদ, তাঁর ভাষার ওজস্বিতা,
রাজ্যসভায় অর্ধনগ্ন অবস্থায় দাঁড়িয়ে সুতীক্ষ্ণ ভাষায় সভাসদদের সমালোচনা তাঁকে
বিশ্বের দরবারে নারীজাতির আদর্শ স্থানে স্থাপন করেছে। নারীপ্রগতীর তিনিই অগ্রদূতী।
তাঁরই আদর্শে উদ্বুদ্ধ ভারতে অজস্র নারী মাথা তুলে দাঁড়িয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদে
মুখর হয়েছেন প্রবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অথবা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ রাজসভায় দাঁড়িয়ে
নিজের বক্তব্য দ্বিধাহীন কন্ঠে ঘোষণা করেছেন। ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ, রানী
রাসমণি, সরোজিনী নাইডু, মাতঙ্গিনী হাজরা প্রমুখ নারী বর্তমান বর্তমান যুগে তারই
দৃষ্টান্ত।
দ্রৌপদীর
ধিক্কারব্যাঞ্জক বাণীর সুতীব্র কষাঘাতেও সভা নীরব-নিরুত্তর। সভাসদ্গন সকলেই
অপরাধবোধে বাকশক্তিহীন হয়ে পড়লেন। দ্রৌপদীর সুনির্দিষ্ট ও সুতীক্ষ্ণ প্রশ্নের কেউই
উত্তর দেননি। অবশেষে নিরবতা ভঙ্গ করলেন পিতামহ ভীষ্ম।
ভীস্ম দ্রৌপদীর ধীক্কারজনক
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিম্নোক্ত কথা বলে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গেলেনঃ
‘অস্বাম্যশক্তঃ পণিতুং পরস্বং
স্ত্রিয়শ্চ ভর্তুর্বশাৎ সমীক্ষ্য।’ – তাঁর বক্তব্য, যুধিষ্ঠির পণে হেরে যাওয়ায়
তাঁর নিজস্ব আর কিছু থাকতে পারে না। ফলে তাঁর পক্ষে পরস্ব (দ্রৌপদী) কে পণ ধরা
সম্ভব নয়। বিপরীত পক্ষে, স্ত্রী স্বামীর অধীন। অতএব যুধিষ্ঠিরের তাঁর স্ত্রীকে পণ
ধরার অধিকার আছে। তাছাড়া যুধিষ্ঠিরের স্বয়ং ‘পরাজিত হয়েছি’ একথা বলার পর আর অন্যথা
করবেন না। কারণ যুধিষ্ঠির পৃথিবী ত্যাগ করতে পারেন, কিন্তু ধর্ম ত্যাগ করবেন না।
সুতরাং সবদিক বিবেচনা করে আমি বিচার করতে অপারগ। এইরকম অজুহাত দেখিয়ে কুরুবৃদ্ধ
পিতামহ বললেন, ‘ন তে প্রশ্নমিমং ব্রবীমি।’ – তোমার এই প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি না।
এর পরেও দ্রৌপদী প্রশ্ন তুলে সমস্ত সভাসদদের কাছে আবেদন জানালেন। বললেনঃ
‘যুধিষ্ঠিরের সমস্ত কিছু জিতে নেওয়ার পর শেষের চাল ছলনা করেই চালা হয়েছে। এই সভায়
কুরুপ্রধানগণ উপস্থিত আছেন, তাঁদের পুত্র ও পুত্রবধূগণের অভিবাবক রূপেও
প্রতিনিধিত্ব করছেন। কুরুকূলের পুত্রবধূ রূপে আমি তাঁদের সকলের কাছে বিনম্র আবেদন
জানাচ্ছি। আপনারা সবদিক পর্যালোচনা করে আমার প্রশ্নের জবাব দিন।’ এরপর তেজস্বিনী
দ্রৌপদী সভাসদ্গণের উদ্দেশ্যে যে বাক্যগুলি বললেন তা নারীজাতির মনে অনুপ্রেরণা
জোগাবে। শুধু তাই নয়, যে জোরালো ভাষায় সভাকে উজ্জীবিত করতে চেয়েছিলেন, তা এতই
আকর্ষক ও হৃদয়গ্রাহী যে, তাঁর সেই ভাষায় প্রকাশিত উদ্দীপক বাক্যগুলি আজো
দিল্লীস্থিত ভারতের সংসদ ভবনে ও পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভবনে স্বর্ণাক্ষরে উৎকীর্ণ
রয়েছে। তিনি বললেনঃ
ন সা সভা যত্র ন সন্তি বৃদ্ধাঃ
ন তে বৃদ্ধাঃ যে ন বদন্তি ধর্মম্ ।
নাসৌ ধর্মো যত্র ন সত্যমস্তি
ন তৎ সত্যম্ যচ্ছলেনানুবিদ্ধম্ ।।
এর বাংলায় বললে এরকম দাঁড়ায় –
বৃদ্ধহীন সভা, সভাপদবাচ্য নয়। আবার যে বৃদ্ধেরা ধর্মের অনুকূলে কথা বলেন না, তাঁরা
সত্যিকারের বৃদ্ধ নন। ধর্ম কাকে বলে? তিনি বললেন, যেখানে সত্য নেই সেখানে ধর্ম
নেই, বা যা সত্য নয় তা ধর্ম নয়। আবার যা ছলনার সাথে যুক্ত তা সত্য নয়।
একথা শোনার পরও সভাসদ্গণ
নিরুত্তর হয়ে বসে রইলেন। কেবল দুর্যোধনের ভাই বিকর্ণ সভার কাছ থেকে দ্রৌপদীর
প্রশ্নের যথাযথ উত্তর জানতে চেয়েছিলেন এবং নিজমত ব্যক্ত করে জানিয়েছিলেন দ্রৌপদী
পণবন্দি নন।
তার উত্তরে কর্ণ তীব্র প্রতিবাদ
ও পরিহাস করে বালক বলে তাকে উপেক্ষা করতে বলল। এরপর কর্ণ দুঃশাসনকে দ্রৌপদীর
বস্ত্রহরণ করার জন্য উৎসাহ দিতে লাগল। উৎসাহিত দুঃশাসন সবলে দ্রৌপদীর বস্ত্র
আকর্ষণ করতে লাগল। কৃষ্ণার অসহায় অবস্থা দেখে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ বিচলিত হলেন।
নিরুপায় দ্রৌপদীও অন্য কোন উপায় না দেখে শ্রীকৃষ্ণকে ডাকতে লাগলেন। লজ্জাবিব্রতা
পাঞ্চালী সভার মাঝে দাঁড়িয়ে কাতরকন্ঠে বলতে লাগলেনঃ
‘গোবিন্দ দ্বারকাবাসিন্ কৃষ্ণ গোপিজন প্রিয়।
কৌরবৈঃ পবিভূতাং কিং ন জ্ঞাস্যসি কেশব।।
হে নাথ, হে রমানাথ ব্রজনাথার্তিনাশন ।
কৌরবার্ণবমগ্নাং মামুদ্ধরস্ব জনার্দন।।
কৃষ্ণ কৃষ্ণ মহাযোগিন্ বিশ্বাত্মন বিশ্বভাবন।
প্রপন্নাং পাহি গোবিন্দ কুরুমধ্যেহবসীদতীম ।।
অর্থাৎ হে গোবিন্দ দ্বারকাবাসী,
হে কৃষ্ণ গোপীজনবল্লভ! কৌরবরা আমাকে কিভাবে নিপীড়িত করছে তুমি কি দেখতে পাচ্ছ না?
হে প্রভু, হে লক্ষ্মীপতি, হে ব্রজেশ্বর, হে দুঃখ নিবারক, হে জনার্দন! আমি কৌরব
সাগরে ডুবে যাচ্ছি। তুমি আমাকে উদ্ধার কর। হে মহাযোগী কৃষ্ণ, তুমি জগতের আত্মা,
তুমি জগৎকল্যাণকারী, কুরুসভায় ভয়ানক কষ্টে পড়ে আমি তোমার শরণ নিচ্ছি। হে গোবিন্দ
তুমি আমাকে বাঁচাও। দ্রৌপদীর এই আকুল আহ্বানে শ্রীকৃষ্ণ সাড়া না দিয়ে পারলেন না।
তিনি অন্তরীক্ষ থেকে বিচিত্র সুবস্ত্রে তাঁর অঙ্গ ঢেকে দিতে লাগলেন। দ্রৌপদী
যেহেতু ধর্ম ত্যাগ করে নি, বরং ধর্ম রক্ষা করেছিল, অতএব তাঁর ধর্ম পালনের জন্যই
বিচিত্র বস্ত্র শয়ে শয়ে আবির্ভূত হতে লাগল। এই অদ্ভুত ঘটনা দেখে সভার মধ্যে ভয়ানক
হৈ চৈ বেঁধে গেল। সভামধ্যে শতচেষ্টা করেও দুঃশাসন দ্রৌপদীকে বিবস্ত্র করতে পারলনা।
শুধু তাই নয়, সে হতোদ্যম হয়ে বসে পড়ল। অপরদিকে বহু বিচিত্র বস্ত্রখণ্ডে দ্রৌপদীর
অঙ্গশোভা বেড়ে উঠল। সভাসদেরা এ দৃশ্যে মুগ্ধ হয়ে দ্রৌপদীর ভূয়সী প্রশংসা এবং
ধৃতরাষ্ট্র পুত্রদের যতেচ্ছ নিন্দাবাদ করতে লাগলেন। এই সুযোগে মধ্যম পান্ডব ভীম
ভয়ঙ্কর প্রতিজ্ঞা করে বসলেন। তিনি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বললেনঃ সভায় উপস্থিত
ক্ষত্রিয়বর্গ শুনুন, আমি যদি পাপাচারী দুর্মতি দুঃশাসনের বুকচিরে তার রক্তপান না
করি, তাহলে আমি পূর্বপুরুষদের গতিপ্রাপ্ত হব না।
এরকম অবস্থায় ধৃতরাষ্ট্র একদিকে
যেমন লজ্জিত হলেন, অপরদিকে ভীমের মুখে ভয়ঙ্কর প্রতিজ্ঞার কথা শুনে ভীত হয়ে পড়লেন।
ফলে সভা মধ্যে আত্মমর্যাদা রক্ষার তাগিদে তিনি দ্রৌপদীর ওপর গভীর সন্তোষ প্রকাশ
করলেন। এবং তাঁকে বর দিতে উদ্দত হলেন। ধৃতরাষ্ট্রের বরে পাণ্ডবগণ দাসত্ব মুক্ত
হলেন এবং হৃত ধনরত্নাদি সহ রাজধানী ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে গেলেন।
কিন্তু দুর্যোধনের চক্রান্তে
পাণ্ডবগণ পুনরায় বনবাসী হলেন। শর্তানুসারে এবার বারো বছর বনবাস এবং এক বছর
অজ্ঞাতবাস।
এখানে দ্রৌপদীর কথা অনিবার্যভাবে
আমাদের মনে আসে। মনে আসে দ্রৌপদী রাজনন্দিনী, রাজকুলবধূ। তিনি কিভাবে বারো বছর
বনবাসে কাটালেন তা ভেবে আমরা চোখের জলে ভেসে যাই। কিন্তু দ্রৌপদী কেবল স্বামীদের
মুখ চেয়ে বনবাসের দুঃসহ দুঃখ ভুলে থেকেছেন। তবে দ্বৈতবনে থাকার সময় অশেষ কষ্টের
মধ্যেও বিদুষী দ্রৌপদী নানা দৃষ্টান্ত দিয়ে যুধিষ্ঠিরকে অন্যায়কারী কৌরবদের
বিরুদ্ধে উত্তেজিত করার চেষ্টা করেছেন। বিপদে ভেঙ্গে না পড়ে, ধৈর্য অবলম্বন করে,
সুস্থ মস্তিস্কে শ্ত্রুর বিরুদ্দে উত্তেজিত করার চেষ্টা করেছেন। এর থেকেই প্রমান
হয় যে দ্রৌপদী সাধারন নারী নন তিনি একজন মহীয়সী নারী।
পাণ্ডবগণ নানা তীর্থ ঘুরতে ঘুরতে
কাম্যকবনে উপস্থিত হলেন। এখানে পাণ্ডবদের পরম হিতাকাঙ্ক্ষী শ্রীকৃষ্ণ তাঁর মহিষী
সত্যভামাকে নিয়ে তাঁদের সাথে মিলিত হলেন। সত্যভামাকে পেয়ে বনবাসিনী দ্রৌপদী আনন্দে
উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। নির্বান্ধব বনবাসে ক্লান্ত কৃষ্ণা সত্যভামাকে মুহূর্তে আপন করে
নিলেন। দুই সখীর মধ্যে অনেক সুখ দুঃখের কথা হতে লাগল। কথাবার্তার ফাঁকে একসময়
সত্যভামাকে দ্রৌপদীকে জিজ্ঞাসা করে বসলেন, ‘সখি, পতি বস করার কি মন্ত্র তুমি জান?
আমাকে সেই মন্ত্র শিখিয়ে দেবে?' এর উত্তরে দ্রৌপদী যা বলেছিলেন এবং সত্যভামাকে যা
উপদেশ দিয়েছিলেন, তা সর্বকালের হিন্দুনারীগণের পক্ষে অমূল্য এবং সর্বদা অনুস্মরণীয়।
তিনি বলেছিলেন স্বামীকে বশ করার জন্য মন্ত্রের প্রয়োগ বা নিন্দাজনক কোন উপায়
অবলম্বন নষ্ট মেয়েরাই করে থাকে। শুধু ওষুধ বিষুধের ব্যবহারে অনেক বিপদ ঘটে। ফলে
ঘরের শান্তি নষ্ট হয়। আমি অহংকারশুন্যভাবে স্বামী ও সতীনরা যা ভালবাসেন তাই করি।
একান্তমনে তাঁদের মনোরঞ্জন করি। স্বামী ছাড়া কোন দেবতা বা মানুষ আমার মনে ঠাঁই
পায়না। স্বামীরা যা ভালবাসেন, সে সব কাজ আমি নিজের হাতে করি। কোন নষ্ট মেয়ের সাথে
আলাপ পর্যন্ত করি না। স্বামীরা কাছে না থাকলে, মুহূর্তকাল আমি সুখ পাইনা। যা তাঁরা
পছন্দ করেন না সে কাজ আমি করি না। তাঁদেরকে দেবতা এবং একমাত্র আশ্রয় মনে করে
তাঁদের সেবা করি। স্বামীদের ভরণীয় এবং আশ্রিত ব্যক্তিদের আমি যথাযোগ্য সৎকার করি।
আমি তাঁদের আয়-ব্যায়ের বিষয় জেনে সর্বদা সেই অনুপাতে সংসার চালাই। সকলের আগে আমার
ঘুম ভাঙে, এবং রাত্রিতে সকলের শেষে আমি শুতে যাই। স্বামীকে বশ করার এইসব উপায়
ছাড়া, নষ্টা মেয়েদের মত অন্য কোন উপায় আমি জানি না।
দ্রৌপদীর এইরকম উত্তর শুনে
সত্যভামা লজ্জিত হলেন। পরে নারীজাতির ভূষণস্বরূপা পান্ডবপ্রিয়া কৃষ্ণার কাছে ক্ষমা
প্রার্থনা করলেন। ঐ ঘটনা থেকে পপ্রমাণিত হয় দ্রূপদনন্দিনী শুধু সুন্দরীই ছিলেন না,
তিনি ছিলেন সর্বকালের সর্বসমাজের নারীজাতির আদর্শ। তাঁর আদর্শের বিন্দুমাত্র
অনুশীলন করলেও বহু অসুখী পরিবার সুখী হতে পারে। দ্বন্দাভিঘাতে দীর্ণ বহু দাম্পত্য
সম্পর্ক বিচ্ছিন্নতার কুঠারাঘাত থেকে রক্ষা পেতে পারে।
দ্রৌপদীর সতীত্বের প্রমানস্বরূপ
আরো দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথমত পাণ্ডবগণ তখন নির্বাসিত হয়ে
কাম্যক বনে বাস করছিলেন। একদিন শিকারের সন্ধানে পঞ্চপান্ডব কুটির থেকে দূরে চলে
গিয়েছিলেন। পান্ডবকুটিরে কেবল পুরোহিত ধৌম্য ছিলেন। দ্রৌপদী কুটির সংলগ্ন নির্জন
বনে একা একা পায়চারি করছিলেন। ঘটনাচক্রে সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ সেখানে হাজির হন।
দ্রৌপদীর অসামান্য রূপ লাবন্যে সে মোহিত হয়। তার মনে হল, এই রমণীকে না পেলে তার
জীবনটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। এই দুষ্ট অভিপ্রায় সিদ্ধির উদ্দেশ্যে সে দ্রৌপদীর কাছে
গিয়ে জানাল, ‘সুন্দরী, আমি সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ! আমি তোমাকে রানী করতে চাই। তুমি
বিধাতার অপরূপ সৃষ্টি, তুমি কেন ভিখিরি পাণ্ডবদের সাথে বনে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছ? তুমি
আমার সাথে চল। আমি তোমাকে মহাসুখে রাখব। বস্ত্রে, অলঙ্কারে তোমাকে ভরিয়ে দেব।’
দ্রৌপদী এ প্রস্তাব শুনে লোভের বশবর্তী তো হলেনই না,
ক্রুদ্ধও হলেন না। অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বিনয় মধুর বচনে জয়দ্রথকে এ অশুভ
চিন্তা পরিত্যাগ করতে করতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু ‘চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী।’
জয়দ্রথের জেদ বেড়ে গেল। কথায় কাজ না হওয়ায় দুরাত্মা দ্রৌপদীর কাপড় ধরে টানতে লাগল।
তখন পাঞ্চালী পুরোহিত দৌম্যকে সকাতরে ডাকতে ডাকতে নিজের কাপড় ধরে জোরে টানলে
জয়দ্রথ হেঁচকা টানে মাটিতে পড়ে গেল। এই ধস্তা ধস্তির মধ্যে পাণ্ডবগণ সৌভাগ্যক্রমে
ফিরে এলেন এবং বিপন্না দ্রৌপদীকে দুর্মতি জয়দ্রথের হাত থেকে উদ্ধার করলেন।
দুর্বৃত্ত জয়দ্রথের হাত থেকে
রক্ষা পাবার পর দ্রৌপদীর জীবনে যে দ্বিতীয় ঘটনা টি ঘটল তাতে তাঁর নির্লোভ ও
সতীত্বের পরিচায়ক মেলে। মৎসরাজের বাড়িতে বিরাটনগরে অজ্ঞাতবাসের সময় দ্রৌপদীকে নিয়ে
পঞ্চপাণ্ডব আত্মগোপন করে বাস করছিলেন। সেই সময় দ্রৌপদী আর এক বিপদে পড়েছিলেন।
বিরাটরাজের শ্যালক কীচক সৈরিন্ধ্রীবেশী পাঞ্চালীর রূপ লাবন্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে
পাটরানী করার প্রলোভন দেখায়। এখানেও দ্রৌপদী কীচকের হাত থেকে সুকৌশলে অব্যাহতি
পায়।
ঘটনাটা ছিলঃ পাণ্ডবগণ বিরাটনগরে
মৎসরাজের বাড়িতে নিরুপদ্রবেই ছিলেন, দ্রৌপদী সৈরিন্ধ্রী নাম নিয়ে বিরাটরাজমহিষী
সুদেষ্ণার পরিচারিকার কাজে নিযুক্ত ছিলেন। দশ মাস নির্বিঘ্নেই কেটে গেল।
অজ্ঞাতবাসের আর দুমাস বাকি। একসময় একদিন দ্রৌপদীসুন্দরী কীচকের নজরে পড়ে গেলেন।
কীচক তাঁকে পাবার জন্য পাগল হয়ে উঠল। বিরাটরাজ্যে কীচক ছিল অত্যন্ত ক্ষমতাশালী।
একদিকে সে ছিল রাজার শ্যালক অন্যদিকে রাজ সেনাপতি। রাজা তাকে সমীহ করেই চলত। ফলে
তার ক্ষমতা ছিল অপ্রতিহত। তাই সে সরাসরি দ্রৌপদীর কাছে গিয়ে বলল, ‘শোন সুন্দরী আমি
তোমার রূপে মুগ্ধ হয়েছি। তুমি এখানে দাসীবৃত্তি করছ। বিরাট রাজ্যের আমিই আসল রাজা।
আমিই সমস্ত ক্ষমতার উৎস। তুমি আমার কাছে এস। তুমি যা চাইবে, তাই পাবে। হীরে,
মণি-মুক্ত দিয়ে তোমাকে ভরিয়ে দেব। এ রাজবাড়ির, এমনকি, এ রাজ্যের সবাই তোমাকে
সম্মান করবে। তুমি কেন এভাবে পড়ে আছ? ফুল ফোটে সৌন্দর্যে গন্ধে অপরকে তৃপ্ত করার
জন্য, অযত্নে অবহেলায় ঝরে পরার জন্য নয়। অতএব এসো সুন্দরী, আমার বাড়ি এস।’
দ্রৌপদী এই প্রস্তাবে রাগ করলেন
না। কীচকের ক্ষমতা, ঐশ্বর্যের আড়ম্বর শুনেও প্রলুব্ধ হলেন না, অথবা ভীতও হলেন না।
তিনি যথোচিত সাহস অবলম্বন করে অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে তাকে নানান যুক্তি দিয়ে
বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে, কীচক যে প্রস্তাব করেছে, তা একজন রাজসেনাপতির পক্ষে
অমর্যাদাকর। তা ছাড়া তিনি (দ্রৌপদী) বিবাহিতা, অন্য পুরুষের সাথে সম্পর্ক রাখা
তাঁর সতীত্বের পক্ষে কলঙ্ক। কিন্তু কামান্ধ কীচক কিছুতেই বুঝতে রাজী হল না। অবশেষে
সাধ্বী দ্রৌপদী তাকে ভয় দেখালেন। আমার স্বামীরা গন্ধর্ব। তাঁরা তোমাকে ক্ষমা করবেন
না। এতেও নিরস্ত না হয়ে কামান্ধ কীচক নিজের বোন বিরাট রাজমহিষী সুদেষ্ণাকে এ পাপ
কাজে সাহায্য করার জন্য পিড়াপীড়ি করতে লাগল। সুদেষ্ণাও পাপমতি ভাইকে বোঝাবার
চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে যায়। তার অনুরোধ রক্ষা করার জন্য কোন এক অছিলায় দ্রৌপদীকে
কীচকের ঘরে পাঠালেন। যাওয়ার আগে দ্রৌপদী সূর্যের স্তব প্রার্থনা করলেন, ‘হে
সূর্যদেব, এই দারুন সঙ্কট থেকে তুমি উদ্ধার কর।’
‘পাণ্ডুপুত্র
বিনা মম অন্যে নাহি মতি।
কীচকের হাতে
মোরে কর অব্যহতি ।।’ – কাশীরাম দাস
প্রাসাদ থেকে দ্রৌপদীকে আসতে
দেখে দুরাত্মা কীচক নীচে নেমে এল। এসে তাঁকে নানারকম প্রলোভন দেখাতে লাগল। সে বললঃ
‘মাং সুখং প্রতিপদ্যস্ব দাসো ভীরু ভবামিতে।
অহ্নায় তব সুশ্রোণি শতং নিষ্কং দদাম্যহম ।।’
তুমি আমাকে বরণ কর আমি তোমার দাস
হয়ে থাকব, প্রতিদিন তোমাকে একশ স্বর্ণ মুদ্রা দেব। তোমাকে আরো দেব, ‘
রথংচাশ্বতরীযুক্তমস্তু নৌ ভীরু সঙ্গমঃ’ – অশ্বতরীযুক্ত রথও দেব, শুধু আমাদের মিলন
হোক। এই বলে দুরাত্মা দ্রৌপদীকে ধরার জন্য বাহু প্রসারিত করল। আত্মরক্ষার জন্য
দ্রৌপদী ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলেন। কীচকও তাঁর পিছন পিছন ছুটলো। দ্রৌপদী ভাবলেন
অন্তঃপুরে গেলে সেখানেও দুরাত্মা বলপ্রয়োগের চেষ্টা করবে। তাই তিনি সরাসরি রাজসভায়
গিয়ে হাজির হলেন। ক্রুদ্ধ কীচক তাঁর চুলের মুঠি ধরে মাটিতে ফেলে লাথি মারল। সভায়
মৎসরাজ স্বয়ং উপবিষ্ট। ভীম-যুধিষ্ঠিরও উপস্থিত। দ্রৌপদী এ অপমান মুখ বুজে সহ্য
করলেন। কিন্তু রাজসভায় দাঁড়িয়ে স্বয়ং রাজাকেই অভিযুক্ত করলেন। নির্ভীক কণ্ঠে
রাজাকে লক্ষকরে দ্রৌপদী বললেনঃ
‘ধর্মাসনে বসি
আছে মৎস্যের ঈশ্বর ।
বিনা অপরাধে
মোরে মারিল বর্বর ।।
দাসীরে মারিতে
নারে রাজার সভায় ।
তোমা বিদ্যমানে
মোরে প্রহারিল পায় ।।
দুষ্ট লোকে
রাজা দণ্ড নাহি দেয় যদি ।
তবে অল্পকালে
তারে দণ্ড দেয় বিধি ।। -- কাশীদাসী মহাভারত
এখানে দ্রৌপদীর সাহসিকতা,
আত্মমর্যাদাবোধ ও সতীত্ববোধ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
যাইহোক দ্রৌপদীর এত অপমান সহ্য
হল না। ঐ দুষ্ট পাপাচারের হাত থেকে কিভাবে মুক্তি পাওয়া যায় ভাবতে ভাবতে তাঁর মনে
হল, একমাত্র ভীমই তাঁকে এ দুঃখের হাত থেকে বাঁচাতে পারেন। মনে হতেই তিনি সেই
রাত্রেই রান্নাঘরে গিয়ে ভীমের কাছে উপস্থিত হলেন। সেখানে তিনি কীচককে শাস্তি
দেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। ভীম দ্রৌপদীকে কথা দিলেন পরদিন রাত্রেই তিনি
কীচককে বধ করবেন। তবে সব কাজ কৌশলে করতে হবে। ঘুণাক্ষরেও যেন কেউ টের না পায়। তিনি
দ্রৌপদী কে বললেন, “সকালে তুমি কীচককে ছলনা করে বলবে, ‘রাজার নৃত্যাগার রাত্রে
ফাঁকা থাকে। আমি সেখানে বিছানায় থাকব। রাত্রের অন্ধকারে নিঃশব্দে তুমি সেখানে গেলে
আমাদের মিলন হবে।’ কিন্তু তুমি সেখানে যাবে না, আমিই সেখানে থাকব।”
সকালে দ্রৌপদী চুপিসারে কীচকের
সাথে দেখা করে সেই কথা জানালেন। কীচক তো মহা খুশি। সন্ধ্যার প্রতীক্ষায় সে উন্মুখ
হয়ে রইল। মাঝে মাঝে সে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগল। ভীমও সন্ধ্যার অন্ধকার
নামতেই সকলের অলক্ষ্যে ললনানৃত্যাগারে ঢুকে খাটের বিছানায় বসে রইলেন। এদিকে কীচক
নানা বসনভূষণে সেজে আতর চন্দন মেখে প্রস্তুত হয়ে বসেছিল। আঁধার নামতেই সে পড়িমরি
করে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে এল। চোরের মত এদিক ওদিক তাকিয়ে চকিতে নাচঘরে
গিয়ে ঢুকল। কারণ, দ্রৌপদীর সাথে শর্ত ছিল, অজান্তেই একাজ করতে হবে।
ঘরে ঢুকেই বিছানায় কেউ বসে আছে
বলে কীচকের মনে হল। ঘুটঘুটে আঁধার, কাছের জিনিসও ঠাহর করা যায় না। তাছাড়া, বিছানায়
দ্রৌপদী ছাড়া অন্য কেউ থাকতে পারে একথা ভাবার মত তার মনের অবস্থাও ছিল না। অতএব
বিছানায় দ্রৌপদীই আছে, এই দৃঢ় ধারণার বশবর্তী হয়ে কামোন্মাদ কীচক ভীমকে জড়িয়ে ধরতে
গেল। ভীম তাকে জাপটে ধরে প্রচণ্ড চাপ দিয়ে পিষে মেরে ফেললেন।
কীচক তো গেল। দ্রৌপদী রটিয়ে
দিলেন, তাঁর অপমানের প্রতিশোধ নিতে তাঁর গন্ধর্ব পতিরা কীচকের এই পরিণতি ঘটিয়েছেন।
কীচকের আত্মীয়রা দ্রৌপদীকেই দোষী সাব্যস্ত করল। রাজার আদেশে দ্রৌপদীকে কীচকের সাথে
বেঁধে একই চিতায় পুড়িয়ে মারার জন্য শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হল। যাওয়ার
পথে দ্রৌপদী জয়, বিজয় ইত্যাদি কাল্পনিক নাম ধরে ব্যাকুলভাবে কাঁদতে লাগলেন। ভীম
দ্রৌপদীর কণ্ঠস্বর চিনতে পেরে সকলের অলক্ষ্যে শ্মশানে গিয়ে হাজার হাজার কীচক বধ করে
দ্রৌপদীকে উদ্ধার করলেন। দ্রুপদ রাজকন্যার এও এক কঠিন পরীক্ষা। এই পরীক্ষায়ও তিনি
সফল ভাবে উত্তীর্ণ হলেন। ঐ অবস্থাতেও তিনি পতিদের মঙ্গল কামনায় তাঁদের নাম উচ্চারন
করেননি। তাঁদের নাম ধরে ডাকলে, তাঁদের পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়লে, আবার বারো বছর
বনবাস। সেই ভয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও পতিপরায়ণা দ্রৌপদী কেবল পতিদের মঙ্গল
চিন্তাই করেছেন। দ্রৌপদীর সতীত্বের এও এক চরম প্রমাণ। আপনার মনে প্রশ্ন জেগেছিল,
দ্রৌপদী কেন নিত্য স্মরণীয়া এবং তাঁর স্মরণে কেনই বা মহাপাপ নষ্ট হবে। এ প্রশ্নের
উত্তর দেওয়া হল।
এবার আধুনিকা বললেন, আপনার
যুক্তিগুলি অকাট্য সন্দেহ নেই, তবে আর একটা প্রশ্ন আমার মনে জাগছে, যদি দয়া করে
বুঝিয়ে বলেনঃ পাঁচহাজার বছর আগেকার কোন এক চরিত্রের বর্তমান আধুনিক যুগে
প্রাসঙ্গিকতা কি?
উত্তরঃ আমাদের মনে হয় যা সত্য,
তা চিরকালই সত্য, সত্য যুগে যুগে পাল্টায় না। নারীরূপে দ্রৌপদী সর্বকালের আদর্শ।
তাঁর লজ্জা, বিনয়, গুরুজনে ভক্তি, বিপদে স্থৈর্য, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, সাহসিকতা,
অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ক্ষমতা, সভাস্থালে বাগ্মিতা, নির্ভীকতা, সর্বোপরি তাঁর
লোভহীনতা ও সতীত্ব আজও প্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে বর্তমান নারীপ্রগতি ও নারীস্বাধীনতার
যুগে দ্রৌপদীর চরিত্র বিশেষভাবে অনুসরণীয়। দ্রৌপদী নারী স্বাধীনতার প্রতীক,
নারীপ্রগতির উজ্জল দৃষ্টান্ত। মনে রাখা প্রয়োজন, স্বাধীনতা ও উচ্ছৃঙ্খলতা সমার্থক
নয়। দ্রৌপদী মর্যাদার সীমা লঙ্ঘন না করেও অন্যায়ের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন এবং
সুচিন্তিত বাক্য বিন্যাসে রাজসভাকে স্তব্ধ করে দিয়েছেন। মহাত্মা বিদুর তাঁর কথার
যুক্তি যুক্ততা অন্ধ্ররাজকে বুঝিয়েছেন। অবশেষে পুত্র স্নেহান্ধ রাজা দ্রুপদ তনয়ার
বাক্যবাণে চেতনা ফিরে পেয়েছেন। তাঁর শ্রীকৃষ্ণের উপর গভীর বিশ্বাস ও ভরসা অতুলনীয়।
তাঁর বিশ্বাস ও ভক্তির জোরেই স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ তাঁর লজ্জা নিবারণ করেছেন। তাঁর
বাগ্মিতা ও অগাধ ভক্তির প্রভাবে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র তাঁর প্রতি তুষ্ট হয়ে বর দিতে
চেয়েছেন। দ্রৌপদী সুযোগ বুঝে তাঁর স্বামীগণের দাসত্বমোচন ও হৃতরাজ্য প্রত্যার্পণের
বর প্রার্থনা করেন। রাজা ধৃতরাষ্ট্র তা মঞ্জুর করেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, একা
দ্রৌপদীই পাণ্ডবগণকে মহাবিপদ থেকে রক্ষা করেন।
আধুনিকা এবার বললেন, সত্যিই আপনি
আমাদের জ্ঞানচক্ষু খুলে দিলেন। এখন আমারও বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে – বর্তমান
অগ্রগামী সমাজেও দ্রৌপদীর অনাবিল অনবদ্য চরিত্র নারী সমাজের আদর্শ। আমারও বলতে
ইচ্ছা করছে ভারতবর্ষের ঘরে ঘরে অসংখ্য দ্রৌপদীর আবির্ভাব হোক।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ ।।
No comments:
Post a Comment