Tuesday, 16 July 2013

বাউল কথা

বাউল কথা

স্বামী পরমানন্দ
প্রিয় আত্মন!
সাত সংখ্যাটি খুবই মহত্ত্বপূর্ণ এবং গুরুত্বপূর্ণ। জীব-জগতের প্রতিটি বিষয়ের সঙ্গে ওতপ্রোত-ভাবে জড়িয়ে আছে এই সাত সংখ্যাটি। এখন এই সম্পর্কে আলোচনা করা যাক।
জীবনের সাতটি স্তর (ডাইমেনসন), যথাক্রমে স্থুল দেহেতে তিনটি স্তর বা অবস্থা- উচ্চতা, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, (হাইট, লেন্থ ও ব্রেডথ), তারপর প্রাণ (আয়ুস্কাল) চতুর্থ, মন- পঞ্চম, বুদ্ধি – ষষ্ঠ এবং চিত্ত (ব্যক্তিত্ব বা অন্তঃকরণ) সপ্তম। অর্থাৎ দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা, আয়ু, মন, বুদ্ধি ও চিত্ত – এই সাতটি স্তর। ঠিক যেমন সাতটি রঙ, যথা – বেগুনী, নীল, আসমানী, সবুজ, হলুদ, লাল ও কমলা। সপ্তাহ – রবি, সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনি।
সপ্তধাতু – রস, রক্ত, মাংস, বসা, অস্থি, মজ্জা ও মেধা। সূর্যের চারিদিকে সাত সাত চৌদ্দটি গ্রহ – এই পর্যন্ত মানুষ জানতে পেরেছে ১০ টি – বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন। প্লুটো ও ভলকানো। আরও চারটি আছে।
জীবকোষের সাতটি ডি. এন. এ। মাতৃগর্ভে শিশুর বৃদ্ধি সপ্তাহ জুড়ে, তাই সপ্তাহ দিয়ে গণনা হয়। নারীর মাসিকচক্র সপ্তাহ ঘিরে। ঋতু আরম্ভ হতে প্রথম সপ্তাহ ঋতুকাল, ঋতুস্নান হতে দু সপ্তাহ গর্ভসঞ্চার কাল এবং ঋতুপূর্ব এক সপ্তাহ গর্ভনিরোধ কাল। এইরূপ ভাবে সাতটি সমুদ্র বা মহাসাগর, সাতটি উপসাগর, সাতটি স্বর, সপ্তলোক ইত্যাদি।
মানুষের জীবনেও প্রথম সাতটি বছর শৈশব, ২য় সাতটি বছর বাল্য, ৩য় সাতটি বছর কৈশোর, তারপর যৌবনের প্রথম চারটি সাত বছর তারুন্য অর্থাৎ ঊনপঞ্চাশ বছর বয়স এবং যৌবনের শেষ তিনটি সাত বছর প্রৌঢ়ত্ব অর্থাৎ সত্তর বছর বয়স। তারপর বার্ধক্য ১১টি সাত বছর অর্থাৎ প্রথম চারটি সাত বছর বার্ধক্যের আরম্ভ, দ্বিতীয় চারটি সাতবছর বার্ধক্যের মধ্য এবং শেষ তিনটি সাত বছর বার্ধক্যের অন্ত। সুতরাং মানুষের মোট একশত সাতচল্লিশ বছর আয়ুষ্কাল।
প্রাণিক স্তরে মানুষ স্তন্যপায়ী – জরায়ুজ শ্রেণীভুক্ত জীব। জরায়ুজভুক্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীরা যে বয়সে সাধারণত বয়ঃপ্রাপ্তি বা শারীরিক সম্পূর্ণতা পায়, সেই বয়সের সাথে সাত গুন করলে যে সংখ্যা পাওয়া যাবে, সেটাই হবে সেই প্রানীর স্বাভাবিক জীবনচক্র বা আয়ুষ্কাল এবং এটি সমস্ত জরায়ুজ স্তন্যপায়ী প্রানীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মানুষ সাধারাণত দৈহিকভাবে পূর্ণ অবয়ত্ব পায় একুশ বছর বয়সে। সুতরাং একুশকে সাত দিয়ে গুন করলে একশো সাতচল্লিশ হয়। সেই হেতু মানুষের যথার্থ বয়স বা আয়ুষ্কাল একশো সাতচল্লিশ বছর। কিন্তু অপঘাত, সংঘাত ইত্যাদি কারণে মানুষ অপরিণত বয়সেই মারা যায়। স্বাভাবিকভাবে অর্থাৎ সঠিক জৈবিকক্রমে খুব কম মানুষ মারা যায়। মানুষ প্রতিনিয়ত মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে অপরিণত বয়েসে।
          মানুষের মৃত্যু সাত প্রকারের, যথা অপঘাত, সংঘাত, রোগ, ভোগ, সংঘর্ষ, স্বাভাবিক ও আধ্যাত্মিক। অপঘাত মৃত্যু অর্থাৎ আত্মহত্যা করে মরা। সংঘাত মৃত্যু অর্থাৎ গাড়ি-ঘোড়া ও যন্ত্রপাতি সংঘাতে মৃত্যু এবং বজ্রাঘাত, সর্পাঘাত, হিংস্র পশুদ্বারা আক্রান্ত হয়ে ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়হেতু মানুষের মারা যাওয়া। রোগজনিত মৃত্যু অর্থাৎ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে এবং মহামারী দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া। ভোগজনিত মৃত্যু অর্থাৎ লালসা, লোভ, ইত্যাদি রিপু দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অতি ইন্দ্রিয় অসংযমহেতু মারা যাওয়া।
সংঘর্ষজনিত মৃত্যু অর্থাৎ দারিদ্র বা অভাবহেতু অপুষ্টির কারণে এবং যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদির কারণে মারা যাওয়া। স্বাভাবিক মৃত্যু অর্থাৎ বার্ধক্যের অন্তর্দশায় মারা যাওয়া। আধ্যাত্মিক মৃত্যু অর্থাৎ যোগে বা আরাধনায় সমাধিস্থ বা যোগস্থ হয়ে দেহ ত্যাগ করা। এটাই সর্বোৎকৃষ্ট বা শ্রেষ্ঠ। সাধারণত মহাযোগী, মহাজ্ঞানী, মহাভক্ত, মহাপুরুষ ও মহীয়সীরা আধ্যাত্মিক মৃত্যু দ্বারা দেহ ত্যাগ করেন।

মহাযোগী অর্থাৎ পরম ধ্যানী।
মহাভক্ত অর্থাৎ পরম প্রেমী।
মহাজ্ঞানী অর্থাৎ পরম জ্ঞানী।
এঁরা জগতের রহস্য এবং জীবনের মর্মকে জেনেছেন – জীবনের পূর্ণত্ববোধ অর্থাৎ বোধে বোধ করেছেন।
জীবন- যাপনের সাতটি সুত্রঃ
শৈশব= ৭ বছর + বাল্য= ৭ বছর +    কৈশোর= ৭ বছর + যৌবন= ২৮+২১ (৪৯) বছর + বার্ধক্য=২৮+২৮+২১ (৭৭) বছর = ১৪৭ বছর মানুষের প্রকৃত আয়ুষ্কাল।

সৌজন্যে, চরৈবেতি, বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন।

বাউল কথা

বাউল কথা
(বস্ত্র ও বাসস্থান)
-      স্বামী পরমানন্দ
বর্তমানে মানুষ নানারকম সিনথেটিক বস্ত্র ব্যবহার করছে, যেমন টেরিকট, টেরিলিন, ডেকরন, পলেস্টার ইত্যাদি। এইগুলি স্বাস্থের পক্ষে খুবই ক্ষতিকারক। সাধারণত সুতি বস্ত্র, পাট ও শনজাত বস্ত্র ও পশম জাতীয় বস্ত্র স্বাস্থের পক্ষে হানিকারক নয়। অতি শীতপ্রধান দেশে চামড়ার বস্ত্র এবং গ্রীষ্মপ্রধান দেশে রেশমবস্ত্র চলতে পারে। তবে গ্রীষ্মপ্রধান দেশে সুতিবস্ত্রই আদর্শ এবং শীতপ্রধান দেশে পশমবস্ত্রই আদর্শ। খুব আঁটো-সাঁটো পোশাক স্বাস্থের পক্ষে ক্ষতিকর। ঢিলে-ঢালা পোশাকই স্বাস্থের পক্ষে উত্তম। কারণ মানবদেহে চামড়ার নিচে স্বেদ গ্রন্থির অবস্থান এবং চামড়ার মধ্যে অসংখ্য রোমকূপ রয়েছে, যেগুলি দিয়ে শরীরের তাপ এবং স্বেদ ও নানা পদার্থ নির্গত হয়। তাই খুব আঁটো-সাঁটো পোশাক পরলে ঐ সব স্বাভাবিক দৈহিক ক্রিয়াগুলি ব্যাহত হয়। তাছারা রক্ত সঞ্চালনের সংবহন ক্রিয়ার অসুবিধা হয়ে থাকে। এর পরিণামে নানারকম চর্মরোগ ও হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়ার অসুবিধা হয়ে থাকে। তাই ঢিলে-ঢালা পোশাক পরিধান করলে এই সমস্ত অসুবিধাগুলি হয় না। বিশেষ করে মানুষ যখন ঘুমাই, সেই সময় কখনই আঁটো-সাঁটো পোশাক পরে শুতে নেই। খুব হালকা এবং ঢিলে পোশাক পরে শোয়াই উত্তম। সুতরাং সুতিবস্ত্রই শ্রেষ্ঠ ও আদর্শ। কারণ এগুলির পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া নেই। কিন্তু অন্য বস্ত্রগুলির পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এইজন্য অবস্থা বিশেষে ও জরুরী অবস্থায় অন্যগুলি মানুষ ব্যবহার করতে পারে, কিন্তু নিয়মিত ব্যবহার করা উচিত নয় – তাতে স্বাস্থের পক্ষে ক্ষতিকর হবে। তবে সুতীবস্ত্র এবং পশমবস্ত্র মানুষ নিয়মিত ব্যবহার করতে পারে, তা স্বাস্থের পক্ষে ক্ষতিকারকও নয়।
এখন বাসস্থান সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। প্রত্যেক মানুষের আশ্রয় প্রয়োজন এবং আশ্রয়ের জন্য বাসস্থান প্রয়োজন আর বাসস্থানে আবাসের জন্য গৃহের প্রয়োজন। তাই কেমন গৃহ আবাসের পক্ষে আদর্শ, সেটা জানা একান্ত প্রয়োজন।
প্রথমে স্থান নির্বাচন করতে হবে। অপেক্ষাকৃত উচ্চস্থান শ্রেষ্ঠ এবং কূর্মপৃষ্ঠসদৃশ  উচ্চস্থান সর্বশ্রেষ্ঠ। কারণ এতে আলো বাতাস প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যাবে এবং স্থানটি ভূগর্ভস্থ জলস্তর থেকে দূরত্বে থাকবে। আর যদি স্থানটি অপেক্ষাকৃত নিম্ন হয়, তাহলে আলো-বাতাসের অপ্রতুলতা দেখা দেবে এবং ভূগর্ভস্থ জলস্তরও নিকটবর্তী হবে। তাই আলো-বাতাসের অভাবযুক্ত ও আর্দ্রতাযুক্ত স্থান প্রকৃত বাসস্থানের অযোগ্য। বিপরীতভাবে আলো-বাতাসযুক্ত এবং আর্দ্রতাহীন পরিবেশ অর্থাৎ স্থানই প্রকৃত বাসস্থানের পক্ষে উপযুক্ত। আবার নিম্ন সমতল এবং আর্দ্রতাযুক্ত স্থান বাগান এবং চাষ–বাসের জন্য উৎকৃষ্ট। আর উচ্চ আর্দ্রতাহীন শুষ্ক স্থান মানুষের বসবাসের জন্য উৎকৃষ্ট।
মাটি, কাঠ, পাথর, বালি, চুন, খর ইত্যদি দিয়ে গৃহ-নির্মাণ উৎকৃষ্ট বা উত্তম। ইট, পাথর, বালি, লহা, সিমেন্ট, কাচ, টিন ইত্যাদি দিয়ে গৃহ-নির্মাণ মধ্যম। অ্যাসবেস্টর, পলিষ্টিন, প্লাস্টিক, চামড়া ইত্যাদি দিয়ে গৃহ-নির্মাণ অধম।
এখন গৃহ-নির্মাণের ‘দিক’ সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। পূর্বমুখী এবং দক্ষিণমুখী ঘড় বসবাসের পক্ষে উপযুক্ত। উত্তরমুখী এবং পশ্চিমমুখী ঘড় বসবাসের পক্ষে অনুপযুক্ত। কারণ পূর্ব ও দক্ষিণমুখী ঘড় প্রচুর পরিমাণে আলো বাতাস পায়। বিপরীতভাবে উত্তর ও পশ্চিমমুখী ঘড় আলো বাতাস পায় না। সূর্যোদয় হতে অস্তকাল পর্যন্ত দক্ষিণমুখী ঘড় আলো বাতাস পাওয়ায় ঘরের বাতাবরণ শুষ্ক হয়। এখানে আর্দ্রতা এবং ছায়া না থাকায় বীজাণু, কিটাণু এবং কীট-পতঙ্গের উপদ্রব হয় না। ছত্রাক, ঘুণ ইত্যাদিরও উপদ্রব হয় না। এই কারণে দক্ষিণমুখী ঘরে বাস করলে শরীর-স্বাস্থ ভাল থাকে; রোগ-ব্যাধির উপদ্রব কম হয় এবং গৃহস্থ-দ্রবসামগ্রী শীঘ্র নষ্ট হয় না বা তাতে পচন ধরে না। তাই সর্বদিক হতে দক্ষিণমুখী গৃহই সর্বশ্রেষ্ঠ। তবে পূর্বমুখী গৃহ ঊষাকাল থেকে অপরাহ্ণ পর্যন্ত আলো পেয়ে থাকে এবং উপসর্গ ও উপদ্রব দক্ষিণমুখী গৃহের মতই কম হয়ে থাকে। সেইহেতু বসবাসের জন্য এটা উৎকৃষ্ট না হলেও উত্তম। অন্যদিকে পশ্চিমমুখী গৃহ ঊষাকাল হতে সূর্যের আলো পায় না। অপরাহ্ণের পর অস্তগামী সূর্যের কিছুটা পড়ন্ত আলো পেয়ে থাকে, যা স্বাস্থের পক্ষে ক্ষতিকর। সর্বদা ছায়া ও আর্দ্রতা থাকায় ঘরের ভিতর নানা পোকা-মাকড় আমদানি হয়, ছত্রাক ও বীজাণুরা বাসা বাঁধে এবং আরশোলা, টিকটিকি, মাকড়সা, ইঁদুর ইত্যাদি প্রাণীদের উপদ্রব হয়। এই জন্য সাপেরা এসে বাসা বাঁধে। কারণ বীজাণু, জীবানু ও ছত্রাক হেচু পোকা-মাকড় হয় এবং পোকা-মাকড় হেতু ইঁদুর, ছুঁচো, টিকটিকি, আরশোলা হয় এবং এদের জন্যই সাপেরা এসে বাসা বাঁধে। যেহেতু একে অপরের খাদ্য।
এই কারণে পশ্চিমদুয়ারী ঘরে বসবাস করলে নানা রোগ-ব্যাধি এবং প্রাকৃতিক উপদ্রব উপস্থিত হয়, শরীর-স্বাস্থ ও মন তামসিকতায় আক্রান্ত হয়। তাই এই গৃহ বস-বাসের অযোগ্য বা অধম। আর উত্তরদুয়ারী ঘড় কখনই সূর্যালোক পায় না এবং ঐ উপদ্রবগুলি অধিক পরিমাণে হয়ে থাকে। তাই উত্তরমুখী গৃহ অতি অধম এবং বসবাসের জন্য সম্পূর্ণরূপে অযোগ্য বা অনুপযুক্ত। বাংলায় একটি প্রবাদবাক্য বা ছড়া আছে যেটা খুবই মহত্ত্বপূর্ণঃ
দক্ষিণদুয়ারী ঘরের রাজা,
পূর্বদুয়ারী তার প্রজা।
পশ্চিমদুয়ারীর মুখে ছাই,
উত্তরদুয়ারীর কাছে না যাই।
সুতরাং পূর্ব এবং দক্ষিণমুখী গৃহ বসবাসের যোগ্য বা উপযুক্ত। পশ্চিম ও উত্তরমুখি গৃহ বসবাসের অযোগ্য বা অনুপযুক্ত।

সৌজন্যে, চরৈবেতি, বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন।

Friday, 12 April 2013

সুখী??



বকরূপী  ধর্মরাজ যুধিষ্টির কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন “কঃ সুখীঃ” – সুখী কে? উত্তরে যুধিষ্টির বলেছিলেন – অপ্রবাসী, অঋণী ও দিনান্তে শাকান্ন ভোজী যে, সেই সুখী।
এবার প্রশ্ন হল প্রবাসী কে? যারা ক্ষুন্নি বৃত্তির তাগিদে অথবা অন্য কোন কারনে নিজেদের স্বদেশ ভূমি ত্যাগ করে বিদেশে বসবাস করতে বাধ্য হয়, তারাই প্রবাসী। আর যারা নিজেদের স্বদেশ ভূমিতে স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত, তারাই অপ্রবাসী। আমরা জন্ম জন্মান্তরের বেদনার দেনার বোঝা মাথায় নিয়ে সেই দেনার দায় পরিশোধ করার জন্য আমাদের স্বদেশ ভূমি দিব্যলোক থেকে মর্ত্যধামে আসি। তাহলে আর অপ্রবাসী হলাম কৈ? মমতায় জরানো সংসারটিকে আঁকড়ে ধরি ছোট্ট একটুখানি সুখের আশায়; শত অসুখের মধ্যেও চলে আমাদের সুখান্বেষণ। সুখের প্রথম শর্ত তাই পুরন হল না।
সুখের দ্বিতীয় শর্ত অঋণী। একটু ভেবে দেখলে এটা পরিস্কার হবে যে, আমরা কেউ অ-ঋণী নই। কারণ জন্মের সাথে সাথে পাঁচটি ঋণ মাথায় নিয়ে পৃথিবীতে আসি যথা- মাতৃঋণ, পিতৃঋণ, ঋষিঋণ, ও দেবঋণ আবার এর সাথে যোগ হয়ে যায় সামাজিক/ রাষ্ট্রিক ঋণ। এর সাথে স্তরে স্তরে ঘনীভূত জলীয় বাষ্প যেমন ঘন মেঘ তৈরি করে, ঠিক তেমনই এই জন্মে বিভিন্ন এষণা দ্বারা তারিত হয়ে আরও আরও ঋণ জমা হয়ে হয়ে নিরেট স্তরীভূত জগদ্দল শিলা আমদের উপর চেপে বসে, ফলে ঋণে জর্জরিত।
এবার সুখের তৃতীয় শর্ত হল দিনান্তে শাকান্ন-ভোজী। Plain living and high thinking without aspersion or aspiration. এক নির্লিপ্ত যতি জীবন। শ্রী ভগবান বললেন –
“কামক্রোধবিযুক্তানাং যতীনাং যতচেতসাম্ ।
অভিতো ব্রহ্মনির্বানং......” (গীঃ ৫/২৬)
কাম ক্রোধ বিমুক্ত সংযত চিত্ত আত্মদর্শী  যতিগণের ব্রহ্মনির্বাণ নিকটেই।
“শাক”- কথাটি শক্ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন হয়েছে- (শক্+ঘঙ্)। শক্ ধাতুর অর্থ সমর্থ হওয়া to be able আবার “অন্ন” শব্দটি উপনিষদাদি শাস্ত্রে জড়ের প্রতীকরূপে ব্যবহৃত হয়। সেই হেতু আমদের জরদেহটাকে বলা হয় আত্মার অন্নময় কোষ এবং ঐ স্তরে আত্মাকে বলা হয় অন্নময় পুরুষ (Physical Self) তাহলে শাকান্ন বলতে বোঝায় জড়ত্বের নির্মোক মোচন করে চেতনার উত্তরণ ঘটানো – “আমার চেতনা চৈতন্য করে দে মা চৈতন্যময়ী”।
এখন প্রশ্ন আমরা মানুষরা সকলে কি সুখী??

--সৌজন্যে চরৈবেতি, বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন।

Thursday, 14 February 2013

সরস্বতী রহস্য

চরৈবেতি, বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনের সৌজন্যে---

সরস্বতী রহস্য


আজ আমরা জ্ঞান দেবী সরস্বতী মূর্তির আড়ম্বর পূর্ণ পূজায় যে স্ম্য ও অর্থ ব্যয় করি তা কি কোন তথাকথিত দেবী বিশেষ, না ঋষি কল্পিত কোন এক মহান তত্ব – জার বাস্তব ব্যাঞ্জনা আমাদের গৌরবময় অতীত সংস্কৃতিকে তুলে ধরে – এটা জানা একান্ত জরুরী। আজ আমাদের কৌতূহলী মনের একান্ত জিজ্ঞাসা শ্বেত শুভ্রা সরস্বতী বীনা হস্তে কেন ? কেন তিনি হংস সমন্বিতা ? তা সম্যকরূপে অবগত হতে না পারলে আমাদের পূজা সার্থক রূপ পায়না। তা কেবল ই হয়ে ওঠে আড়ম্বর সর্বস্ব – তাই ঘটেছে ও ঘটছে। আমাদের জীবনের গতি হবে জানার দিকে কোন কিছুতেই নির্বিচারে মানা নয় বরং তা সবিচারে জানা। প্রকৃত সত্য কে জানলে তা মানতে কারুরই আপত্তি থাকার কথা নয় – তা সে যে পন্থী বা ধর্মাম্বলীই হোক না কেন।

        “সরস্বতী” কথার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ – ‘সরস’ –এর সাথে বতুপ প্রত্যয় যোগে অ স্ত্রী লিঙ্গে ‘ঈ’ যোগ করে ‘সরস্বতী’ শব্দটি নিষ্পন্ন হয়েছে। ‘সরস’ কথার অর্থ রসাল বা সমৃদ্ধ, ক্ষমতা থাকা অর্থে বতুপ প্রত্যয়। তাহলে সরস্বতী কথার অর্থ দাঁড়ায় সমৃদ্ধ বা উন্নত করার ক্ষমতা যার আছে এমন কোন ব্যক্তি বিশেষ।

        প্রথম প্রথম বৈদিক ঋষিদের দৈনন্দিন জীবনে দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় ধরা পড়ে জলের সরস্বতী রূপ। কারণ কৃষি, শিল্প, এমনকি বাঁচার যে কোন তাগিদেই জলের একান্ত প্রয়োজন। জল যেন মাতৃস্বরূপা, যার পবিত্র স্পর্শে জীবকুল হচ্ছে নিয়ত লালিত-পালিত। তাইতো ঋষিগন হিমালয় জাত সে যুগের শ্রেষ্ঠ স্রোতস্বিনীর নামকরণ করেছিলেন সরস্বতী, যা কালে প্রাকৃতিক বা মনুষ্য সৃষ্ট কারনে বিলুপ্ত। পরে পরে অভিজ্ঞতা ও মনীষা যখন আরো উন্নত ও পরিবর্ধিত হতে শুরু করল তখন বিচক্ষনেরা খুঁজে পেলেন প্রকৃত সরস্বতীকে আর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা জাত কল্পনায় রূপ দিলেন এক বিষয়কর মূর্তিরূপ মানচিত্রকে।

        জ্ঞান মানুষের জীবনকে সমৃদ্ধ করে, সমস্ত রকম প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সাহায্য করে, সমস্ত সমস্যার সমাধান’ই হচ্ছে আমাদের অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান। আমাদের এই মরুভূমির মতো জীবন তাই সুখে, শান্তিতে ও জ্ঞানের ঐশ্বর্যে ভরে ওঠে। সেজন্যই জ্ঞানদেবী সরস্বতী শ্বেতশুভ্রা – শ্বেতবসনা।

হংস-ই একমাত্র প্রানী যারা দুধ ও জলের মধ্যে শুধুমাত্র দুধের ভাগটা টেনে নিতে পারে, এবং এরা মাটি, বাতাস, জল সর্বত্র অবাধ বিচরন করতে পারে। জ্ঞানীই একমাত্র সব জায়গায় গ্রহণযোগ্য ব্যাক্তি এবং ভাল-মন্দ, সৎ-অসৎ, গুন-দোষ আলাদা করতে পারে তাই সরস্বতীর মূর্তির সাথে জন্স থাকে।

        পদ্ম ফুল জলেই স্থিতি অথচ জল ধারন করতে পারেনা। একই বৃন্তে গাথা শত পাপড়ির ন্যায় সংসার আবর্তে থেকে জ্ঞানীর বুদ্ধিদীপ্ত মন বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শত চিন্তা ভাবনা একত্রিত করে অনায়াসে আয়ত্ত করতে পারে।

        এখানে বীনা কোন বাদ্যযন্ত্র নয়। ইহা দেহরূপ বীনা যন্ত্র। ভারতীয় শাস্ত্র মতে যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তাই আছে এই দেহভান্ডে। বীনা যন্ত্রের সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-র ন্যায় মনের একগ্রতায় ঝংকৃত করে তুলতে হবে দেহস্থিত কুলকুণ্ডলিনী শক্তিকে ষটচক্ররূপ মূলাধার (গুহ্যদ্বারে নিকটস্থ গ্রন্থি), স্বাধিষ্ঠান (লিঙ্গ দ্বার স্থিত গ্রন্থি), মণিপুর (নাভি মণ্ডলস্থিত গ্রন্থি), অনাহত (বক্ষঃস্থলস্থিত গ্রন্থি), বিশুদ্ধ (কন্ঠনালিস্থিত গ্রন্থি) ও আজ্ঞাচক্র (ভ্রু যুগলের মধ্য স্থিত গ্রন্থি) ভেদ করে সহস্রারে (মস্তিস্ক স্থিত গ্রন্থি) উত্তরনের এক মহাসুর।

সরস্বতী মূর্তির এই ব্যাখা কবিতার ছন্দে ক্ত সাবলীল ও সহজ- সরল তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে তা বাঁকুড়া জেলার এক অপরিচিত শ্রদ্ধেয় কবি শ্রী অজিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় –এর নাম উল্লেখ করতেই হয়। কবিতাটি উদ্ধৃত করা হলঃ-

ঐ যে সরস্বতী                 ঐ যে জ্ঞানদেবী
কেন শ্বেতশুভ্র ?               কেন হাতে বীনা ?
কেন যে হংস ?                পদ্ম কেন ঐ ?
পুজো করি মোরা জানিনা।
জ্ঞান ই সরস করে    জীবন মরু
ফুলে-ফলে ভরে ওঠে জ্ঞানের তরু,
খেই হারা প্রশ্নের              আলোসম সমাধান, তাই
জ্ঞানদেবী শ্বেতবসনা।
মাটি জল কিংবা               সুদূর আকাশে
ঐ যে হংস দেখি,
যে দুধটুকু নিয়েনেবে অপরূপ সৃষ্টি
জলটুকু পাত্রেই রাখি।
জলেতে থেকেও              ওর গায়ে জল নেই
একই বৃন্তে গাঁথা             ঐ শতদল
একটি মনের সহস্র চিন্তা (তাই)
সপ্তসুরের দেহ বীনা ।।