Wednesday, 25 March 2015

তপস্বিনী অহল্যা



আমরা রামায়নে অহল্যার নাম সকলেই শুনেছি। গৌতমমুনির স্ত্রী ছিলেন অহল্যা। স্বামীর শাপে পাষাণে পরিণত হয়ে গিয়েছেলেন। দীর্ঘকাল এভাবে থাকার পর ভগবান শ্রীরামচন্দ্র তাঁকে মুক্তি দেন। এটাই ছিল দু-এক লাইনে অহল্যার চরিত্র। তিনিও ছিলেন পঞ্চকন্যার অন্যতম, আমরা পুনরায় সেই শ্লোকটি দেখে নিই-
‘অহল্যা, দ্রৌপদী, কুন্তি, তারা মন্দোদরী তথা।
পঞ্চ কন্যাং স্মরেন্নিত্যং মহাপাতক নাশনম্ ।।’

অহল্যা, দ্রৌপদী, কুন্তি, তারা ও মন্দোদরী এই পঞ্চ কন্যার নিত্য স্মরণে মহাপাপ নাশ হয়। কেন তাঁর নিত্য স্মরণে মহাপাপ নাশ হয়  তা আমরা দেখব, এবং যার জন্য দেখতে পাব সেটি অবশ্যই বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনের “চরৈবেতি”।

তপস্বিনী অহল্যা

স্বয়ং ব্রহ্মা অহল্যা নামক সুন্দরী সৃজন করে ইন্দ্রকে বললেনঃ

“ততো ময়া রূপৈগুণৈরহল্যেতি নির্মিতা।
হলং নামেতি বৈরূপ্যং হল্যং তৎপ্রভবং ভবেৎ।।” (বাল্মীকি রামায়ণ/ বালকাণ্ড)

অর্থাৎ রূপে-গুণে অতুলনীয়া অহল্যা নামে রমণী আমি সৃষ্টি করেছি। ‘অহল্যা’ নাম কেন, তাঁর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বললেনঃ ‘হল্য’ শব্দের অর্থ বিকৃতি। অতএব যে নারীর মধ্যে রূপে বা গুণে কোন বিকৃতি নেই, তিনিই অহল্যা। এর থেকে বোঝা যায়, অহল্যা সর্বাঙ্গ সুন্দরী। শুধু রূপে নয়, গুনেও তিনি সবার সেরা। বাঙালী কবি কৃত্তিবাস অহল্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেনঃ

“সহস্র সুন্দরী সৃষ্টি করিলেন ধাতা।
সৃজিলেন তা সবার রূপেতে অহল্যা।
ত্রিভুবনে সৌন্দর্যে না ছিল তার তুল্যা।।

কবি বলতে চেয়েছেন ব্রহ্মা সহস্র সুন্দরীর রূপ একত্র করে পরম রমণীয় এক রমণী সৃষ্টি করলেন, যার নাম অহল্যা। এই অহল্যা পরবর্তীকালে শাপগ্রস্তা হয়েছিলেন। শাপগ্রস্তা অহল্যাকে হিন্দীকবি সন্ত তুলসীদাস ও বাঙালীকবি কৃত্তিবাস উভয়েই পাষাণ দেহধারী বলে বর্ণনা করেছেন। যথা, সন্ত তুলসীদাসের ‘শ্রীরামচরিত-মানস’ -এ পাইঃ
‘গৌতমনারি শ্রাপবস উপলদেহ ধরি ধীর’ – এর অর্থ- গৌতমের পত্নী অহল্যা শাপবশত প্রস্তর দেহধারণ করে ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করে আছেন।
আবার, কবি কৃত্তিবাস বলেছেনেঃ

“অহল্যাকে শাপিলেন ক্রোধে মুনিবর।
শাপ দিনু তোর তনু হউক প্রস্তর।।”

স্বয়ং বাল্মীকি প্রস্তরদেহের কথা বলেননি। বাল্মীকি রামায়ণে অহল্যার প্রতি গৌতমমুনির শাপের কথা এভাবে বলা হয়েছেঃ
‘ভার্যামপি শপ্তবান্।
ইহ বর্ষ সহস্রাণি বহূনি নিবসিষ্যসি।।
বাতভক্ষা নিরাহারা তপ্যন্তী ভস্মশায়িনী।
অদৃশ্যা সর্বভুতানামাশ্রমেহস্মিন্ বসিষ্যসি।।’-- (বাল্মীকি রামায়ণ/ বালকাণ্ড, ৪৮ তম সর্গে, ৩৯ নং শ্লোক)

বাংলায় এর সরলার্থ হলঃ গৌতমমুনি স্বপত্নী অহল্যাকে এই বলে শাপ দিলেনঃ তুমি এই আশ্রমে ভস্মশায়ী হয়ে (ছাই-এর গাদায় শুয়ে) সকলের অলক্ষ্যে বহু হাজার বছর তপস্যা কর। তপস্যাকালে কেবলমাত্র বায়ুই তোমার আহার হবে। গৌতমের অভিশাপ বাণী থেকে স্পষ্ট, তিমি অহল্যাকে নিষ্প্রাণ পাষাণে পরিণত করার অভিশাপ দেননি।

তবে পরবর্তী দুই কবির কল্পনায় অহল্যা কেন পাষাণ দেহধারী হলেন, তাঁর কারণানুসন্ধান প্রয়োজন।
আমাদের মনে হয়, অহল্যার পাষাণ হওয়ার গল্প রূপক মাত্র। কারণ দীর্ঘকাল বায়ুমাত্র আহার করে একাগ্রচিত্তে তপস্যায় মগ্ন থাকার ফলে তাঁর দেহ অস্থিচর্মসার হয়ে গিয়েছিল, সে দেহে বাহ্য চেতনারও প্রকাশ ছিল না। তাই ঐ দেহকে জড় পাষাণের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। যদিও তাঁর অন্তশ্চেতনা ছিল। এ এক প্রকারের সমাধি।

যুক্তিবাদীরা একে গাঁজাখুরি গল্প বলে উড়িয়ে দিতে পারেন। আমরা সবিনয়ে জানাতে চাই, আধুনিক যুগেও এরকম ঘটনা ঘটে থাকে। বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশ্চন্দ্র বসু তাঁর ‘অব্যক্ত জীবন’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, বাইরে প্রাণের প্রকাশ না থাকলেও ভিতরে চেতনা থাকে। ঐ প্রবন্ধে তিনি জনৈক সাধুর উল্লেখ করেছেন, যাকে লোহার বাক্সে বন্ধ করে মাটির গর্তে পুঁতে দেওয়া হয়েছিল। তিন দিন পড়ে যখন তাঁকে তোলা হল, তখন তাঁর দেহে প্রাণ ছিল- যাকে লেখক অব্যক্ত জীবন বা latent life বলেছেন। বাইরের আলো-বাতাসের সংস্পর্শে ঐ সাধু পুনরায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন।

বায়ুমাত্র আহার করে দীর্ঘকাল বেঁচে থাকা যায় কিনা, এ সংশয় নিরসনের উদ্দেশ্যে আমরা স্বামী বিবেকানন্দের স্বচক্ষে দেখা পওহারী বাবার স্মরণ করতে চাই। পওহারী কথাটা এসেছে পবন আহারী থেকে। পবন (বায়ু) আহার যার, তিনিই পওহারী

তার প্রমান মহামহোপাধ্যায় গোপীনাথ কবিরাজের লেখা মানুষ যে ‘পাষাণ’ হয়ে যায় তা ‘জ্ঞানগঞ্জ’ বই-এ পাওয়া যায়। জ্ঞানগঞ্জে বহু সাধক হাজার হাজার বছর ধরে একাসনে বসে তুষারাকৃতি হয়ে গেছেন। কিন্তু চেতনা হারাননিপরম পুজনীয় গুরুজী পরমানন্দ স্বামী এরকম দু’জন সাধকের সাক্ষাৎ পেয়েছেন। এঁদের মধ্যে একজন বাবাজী মহারাজ, যিনি স্ফটিকদেহ থেকে ওঁ নমঃ শিবায় মন্ত্রে সচল মনুষ্যরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। গুরুজী ধ্যানযোগে জেনেছিলেন, সাধনশক্তি ও যোগবিভূতির সাহায্যে বাবাজী মহারাজ প্রায় চার হাজার বছর ঐ একই শরীরে বিদ্যমান।
দ্বিতীয় জন বৌদ্ধ শ্রমণ। বন্ধমুখ বায়ুশূন্য অন্ধকার গুহায় আড়াই হাজার বছর তিনি ধ্যনস্থ ছিলেন। দেহ কঙ্কালসার। অথচ তাঁর অন্তশ্চেতনা লোপ পায়নি। ভোজন তো দূরের কথা, গুহামুখ বহু কালের মৃত্তিকাগুল্মে আচ্ছাদিত থাকায়, গুহার ভিতরে বায়ুপ্রবেশের পথ ছিল কিনা বলা মুশকিল। প্রসঙ্গ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলাম। এবার অহল্যার কথায় ফেরা যাক্। অহল্যার শাপমুক্তির উপায় ঐ তিন রামায়ণে একই বলা হয়েছে। বাল্মীকি বলেছেনঃ

‘যদা ত্বেদং বনং ঘোরং রামো দশরথাত্মজঃ।
আগ মিষ্যতি দুর্ধস্তদা তদাপুতা ভবিষ্যামি।।’ - (বাল্মীকি রামায়ণ/ বালকাণ্ড, ৪৮ সর্গ, ৩৯ নং শ্লোক)


বঙ্গানুবাদ করে বলা যায়, দশরথপুত্র রামচন্দ্র যখন এই ভয়ঙ্কর বনে আসবেন, তখন তুমি শাপমুক্ত হয়ে পবিত্র হবে। তুলসীদাসী রামায়ণে দেখি, মহর্ষি বিশ্বামিত্র শ্রীরামকে বলছেনঃ ‘চরণকমলরজ চাহতি কৃপা করহ রঘুবীর।’ অর্থাৎ হে রঘুবীর! আপনার চরণধূলি প্রার্থনা করছেন ঐ পাষাণ দেহধারী অহল্যা; আপনি ওর প্রতি কৃপা করুন। [শ্রীরামচরিত মানস – বালকাণ্ড – পৃঃ ১৮১]

এরপর ‘পরসত পদপাবন সোক নসাবন প্রগট ভঙ্গ তপপুঞ্জ সহী’ শ্রীরামচন্দ্রের চরণ –স্পর্শ পাওয়ামাত্র পাষাণময়ী অহল্যা নড়ে উঠলেন, তাঁর অব্যক্ত প্রাণ ব্যক্তভাব ধারণ করল। তিনি করজোড়ে শ্রীরামের সম্মুখে দণ্ডায়মান হলেন।
এবার কবি কৃত্তিবাস অহল্যা শাপমুক্তির কথা কিভাবে বর্ণনা করেছেন, দেখে নেওয়া যাক্। অহল্যার কাতর প্রার্থনায় ঋষি গৌতম বললেনঃ-

‘জন্মিবেন যবে রাম দশরথের ঘরে।
বিশ্বামিত্র লয়ে যাবে যজ্ঞ রাখিবারে।।
তোমার মাথায় পদ দিবে নারায়ণ।
তখনি হইবা মুক্ত .........।।‘
                                                     (কৃত্তিবাসী রামায়ণে - পৃঃ ৬৫)

এ পর্যন্ত আলোচনায় জানা গেল, অহল্যা স্বয়ং ব্রহ্মার সৃষ্টি, ত্রিলোকসুন্দরী, রূপে গুণে অতুলনীয়া অথচ শাপগ্রস্তা। কেন? এ প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য পিছন ফিরে তাকাতে হবে।

মহর্ষি বিশ্বামিত্র অযোধ্যাপতি দশরথের দুই পুত্র রাম-লক্ষণকে নিয়ে রাক্ষস বধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন। ভয়ঙ্কর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথ। পথে সিদ্ধাশ্রমে তাঁরা রাত্রি বাস করলেন। পরে ইক্ষাকু বংশের রাজা সুমতির বিশাল নগরী অতিক্রম করে মিথিলার দিকে এগিয়ে চললেন। মিথিলার উপবনে একটি পরিত্যক্ত জীর্ণ, জনপ্রাণীশূন্য আশ্রম দেখে রাজকুমারদ্বয় মহর্ষির কাছে ঐ আশ্রমের বৃত্তান্ত জানতে চাইলে মহর্ষি তাঁদের ঋষি গৌতম ও তাঁর পত্নী অহল্যার কাহিনী শোনালেনঃ

“একদা ঋষি গৌতম তীর্থ স্নান সেরে, একহাতে কুশের গোছা, অন্যহাতে যজ্ঞকাষ্ঠের বোঝা নিয়ে আশ্রমে ফিরছেন। তপজ্যোতিতে দেদীপ্যমান তাঁর সর্বাঙ্গ। এদিকে দেবরাজ ইন্দ্র আশ্রম ফাঁকা পেয়ে গৌতম মুনির বেশ ধরে চুপিসারে আশ্রমে প্রবেশ করলেন তাঁর আদিম বাসনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে। কৃতার্থ হয়ে দেবরাজ বাইরের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই চমকে উঠলেন। একি! অপূর্ব জ্যোতিচ্ছটায় আশ্রমমুখী পথ উদ্ভাসিত। সাক্ষাৎ অগ্নি যেন আশ্রমের দিকে এগিয়ে আসছে। দেবরাজের বুঝতে বাকি রইল না, ঐ জ্যোতিঃপুঞ্জ ঋষি গৌতমের দেহোভিন্ন আলোকচ্ছটা। দ্রুতপদে পালাতে গিয়ে গৌতমের সামনে পড়ে গেলেন। ঋষিবর ইন্দ্রের অপকীর্তি বুঝতে পেরে অভিশাপ দিলেন। পরে আশ্রমে পৌঁছে স্বপত্নী অহল্যাকে অভিশাপ দিলেন। স্বীয় পত্নীকে পাপের দণ্ড দিয়ে, তার মুক্তির উপায়ও বলে দিলেন। এরপর গৌতম ঋষি অহল্যাকে একা ফেলে রেখে আশ্রম ত্যাগ করে দুশ্চর তপস্যার জন্য হিমালয়ে চলে গেলেন। সেই থেকে এই আশ্রম শূন্য পড়ে আছে। এখানেই অহল্যা একান্ত নিরিবিলিতে মনুষ্য, মনুষ্যেতর প্রাণী, এমনকি দেবাসুরেরও অলক্ষ্যে  থেকে সম্পূর্ণ নির্বিঘ্নে সুকঠোর তপশ্চর্যায় রত আছেন।”

এই আখ্যান শুনিয়ে ঋষি বিশ্বামিত্র শ্রীরামচন্দ্রকে বললেন, “চলো বৎস, পুণ্যকর্মা মহর্ষি গৌতমের আশ্রমে গিয়ে দেবীরূপিণী মহীয়সী অহল্যাকে উদ্ধার কর।” “তারয়ৈনাং মহাভাগামহল্যাং দেবরূপিণীম।” - (বাল্মীকি রামায়ণ/ বালকাণ্ড- ৪৯ সর্গ/ ১২)

বিশ্বামিত্রের কথায় শ্রীরাম, লক্ষণের সাথে ঋষিবরকে অনুসরণ করে আশ্রমে প্রবেশ করলেন। স্বীয় তপস্যার তেজে জাজ্বল্যমান অহল্যাকে দেখলেন। তিনি তপোজ্যোতিঃপুঞ্জে নিজেকে এমন ভাবে আচ্ছাদিত করে রেখেছিলেন যে, মানুষ তো দূরের কথা, দেবতা বা অসুরের পক্ষেও ঐ জ্যোতিঃপুঞ্জ ভেদ করে তাঁর দর্শনলাভ অসম্ভব ছিল।

গৌতমমুনির শাপবশত শ্রীরামের দর্শন না হওয়া পর্যন্ত ত্রিলোকের যে কোন প্রানীর পক্ষে অহল্যা দুর্নিরীক্ষ ছিলেন। শ্রীরামচন্দ্র আশ্রমে পদার্পণ করা মাত্র তাঁর শাপান্ত হওয়ার ফলে তিনি সকলের দর্শনগোচর হলেন। এবার দাশরথি ভাতৃদ্বয় অহল্যার চরণ বন্দনা করলেন। “রাগবৌ তু তদা তস্যাঃ পাদৌ জগৃহতুমুর্দা” - (বাল্মীকি রামায়ণ/ বালকাণ্ড- ৪৯ সর্গ/ ১৭)। অহল্যাও যথাবিধি তাঁদের আপ্যায়িত করলেনরাম–লক্ষণ দুই ভাই পরম তৃপ্তি সহকারে সেই আপ্যায়ন গ্রহণ করলেন। এই ঘটনায় দেবগন্ধর্ব ও অপ্সরাকুল আনন্দিত হলেন। স্বর্গ থেকে দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি করলেন। গৌতমমুনির নির্দেশে কঠোর তপশ্চর্যার বলে ও শ্রীরামচন্দ্রের দর্শনের ফলে অহল্যা তাঁর নিষ্পাপ পূর্ব শরীর ফিরে পেলেন।

এই কাহিনী থেকে অহল্যা শাপগ্রস্ত কেন, তা জানা গেল। কিন্তু এখানে একটা বিষয় বিচার্যঃ অহল্যা কি সত্যিই অপরাধী? অহল্যা তো দেবরাজ ইন্দ্রকর্তৃক প্রতারিত। ইন্দ্র গৌতমমুনির ছদ্মবেশে অহল্যার সঙ্গ কামনা করেছিলেন। অহল্যা সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে তো কোন অন্যায় করেনি।

কিন্তু আর একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, অহল্যা অপরাধিনী, আত্মপ্রবঞ্চক। কেননা, অহল্যা ইন্দ্রকে গৌতমের ছদ্মবেশধারী বলে চিনতে পারলেও তাঁর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন স্রেফ কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে। যথা,

“মুনিবেষং সহস্রাক্ষং বিজ্ঞায় রঘুনন্দন।
মতিং চকার দুর্মেধা দেবরাজকুতুহল্যাৎ ।।” 
-- (বাল্মীকি রামায়ণ/ বালকাণ্ড- ৪৮ সর্গ/ ১৯-২০)

পরের শ্লোকে অহল্যার দুর্মতিত্ব অ্যারো স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে, যেখানে মহর্ষি বাল্মিকি তাঁর মুখ দিয়ে বলাচ্ছেনঃ

“কৃতার্থাস্মি সুরশ্রেষ্ঠ গচ্ছ শীঘ্রমিতঃ প্রভো।
আত্মানং মাং চ সর্বথা রক্ষ গৌতমাৎ।।

-অহল্যা যে দেবরাজকে চিনতে পেরেছিলেন, তার প্রমান নিজ মুখেই দিয়েছেন ইন্দ্রকে সুরশ্রেষ্ঠ বলে সম্বোধন করে। তাঁর অপরাধের আরো স্পষ্ট প্রমাণ, তিনি নিজ মুখেই বলেছেন, ‘আমি কৃতার্থ হয়েছি।’ তাঁর উক্তির মধ্যে কোন অনুশোচনার প্রকাশ নেই। অতএব তিনি জেনেশুনে পাপ করেছেন। সামাজিক দৃষ্টিতে, সততা বা সতীত্বের বিচারে যা গর্হিত অপরাধ। তাই প্রশ্ন ওঠে সেই বহু প্রচলিত শ্লোক নিয়ে, যথাঃ

‘অহল্যা, দ্রৌপদী, কুন্তি, তারা মন্দোদরী তথা।
পঞ্চ কন্যাং স্মরেন্নিত্যং মহাপাতক নাশনম্ ।।’

-যে পঞ্চকন্যার স্মরণ করলে মহাপাপের নাশ হয়, সেই পঞ্চকন্যার নামের তালিকার আদিতে অহল্যার নাম রয়েছে। তার মানে, ঐ কন্যার মধ্যে অহল্যাই শ্রেষ্ঠ। কিন্তু তা কি করে হয়?

অহল্যার সমগ্র জীবন পর্যালোচনা করে আমরা দেখেছি, কৌতূহলের বশে অহল্যা যে পাপে লিপ্ত হয়েছিলেন, সে পাপ তিনি গোপন করার বা অস্বীকার করার কোন চেষ্টা করেন নি। পতির অভিশাপেরও কোন প্রতিবাদ করেন নি। বরং স্বামীর নির্দেশ মেনে নির্জন আশ্রমে বহু হাজার বছর ধরে শ্রীরামের চিন্তাই করেছেন। এ এক কঠোর তপশ্চর্যা ও প্রায়শ্চিত্ত। প্রায়শ্চিত্তের দ্বারা পাপ খণ্ডন হয়, এ বিধান সকল শাস্ত্রেই আছে। যথাঃ ‘প্রায়শ্চিত্তানি পাপক্ষয় সাধনানি চান্দ্রায়ণাদীনি’ – (বেদান্তসারঃ অধিকারি নির্ণয়ঃ ১১)। অর্থাৎ পাপক্ষয় করার উপায় চন্দ্রায়ণব্রত ও অন্যান্য কৃচ্ছ্রসাধনমূলক তপস্যা। অহল্যা সেই তপস্যায় সিদ্ধ হয়েছেন এবং তাঁর পূর্বকৃত পাপেরও বিনাশ হয়েছে। প্রায়শ্চিত্তের আগুনে অহল্যার মনের কামাদি রিপু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তিনি এখন শুচিশুদ্ধ। আরো বিচার্য, অহল্যা শুধু শারীরিক কৃচ্ছ্রসাধনাই করেননি, তার সাথে তিনি ধ্যান-জপেও মগ্ন ছিলেন। যেহেতু তাঁর শাপমোচনের একমাত্র উপায় ছিল শ্রীরামের দর্শন ও তাঁর আপ্যায়ন, তাই তিনি নিরন্তর রামনাম জপ ও ধ্যান করেছেন। যেহেতু তাঁর বায়ুমাত্র আহার্য ছিল, তাই তাঁর ক্ষুৎপিপাসা বিবৃত্তির জন্য উদ্বেগ ছিল না। আবার আশ্রম সর্বপ্রকার জীববর্জিত হওয়ায় তাঁর মনোযোগ খণ্ডিত হওয়ার কোন আশঙ্কা ছিল না। এভাবে তাঁর সমগ্র চিত্তবৃত্তির নিরোধ হওয়ায় তিনি যোগযুক্ত হয়েছিলেন। পাতঞ্জল যোগশাস্ত্রে আরো আছেঃ ‘তজ্জপস্তদর্থভাবনম্।’ –(রাজযোগ সমাধি পাদ-২৮) এই সুত্রে বলা হয়েছে, ঈশ্বরের বাচক শব্দ ওঁকারের জপ ও তার অর্থ চিন্তন করলে মানুষের অন্তঃস্থিত কুসংস্কারসমূহ সূক্ষ্ম হ’তে হ’তে ক্রমশ বিলীন হয়ে যায়, ওপর পক্ষে মনের গভীরতর স্তরে চাপা পড়ে থাকা আধ্যাত্মিক সংস্কারগুলি ওপরের স্তরে ভেসে ওঠে। এতে মানুষের অন্তর এত পবিত্র হয় যে, অন্তর্দৃষ্টি বিকশিত হওয়ার ফলে সে দেবত্বে উপনীত হয়। এখানে উল্লেখ্য ওঁ শব্দ যেমন ঈশ্বরের বাচক, তেমনি ‘রাম’ শব্দও ঈশ্বরের বাচক। রাম নামে যে পাপক্ষয় হয় তার প্রমান দস্যু রত্নাকরের গল্পেও পাওয়া যায়।

শ্রীরামের দর্শন পেয়ে অহল্যা তাঁর স্তুতি করলেনঃ

“ম্যায় নারি অপাবন প্রভু জগপাবন ...... রাজীবলোচন ভবভয়মোচন পাহি পাহি সরলহিং আঈ।” – (রামচরিত মানস)
বাংলায় যার অর্থ হ’ল, হে প্রভু, আমি অপবিত্র নারী, আপনি জগৎপাবন, ভবভয়হরণকারীকৃপা করে আমাকে রক্ষা করুন, আমি আপনার শরণাগত।
আমরা জানি, শ্রীরাম শরণাগতবৎসল। শত্রু পক্ষ থেক আগত শরণার্থী বিভীষণকে আশ্রয় দিতে তাঁর বন্ধুবর্গ বাধা দিলেও শ্রীরাম বলেছিলেনঃ

“সকৃদেব প্রপন্নায় তবাস্মীতি যাচতে।
অভয়ং সর্বভূতেভ্যো দদাম্যেতদ্ ব্রতং মম।” 
–(বাল্মীকি রাঃ যুদ্ধ কাঃ/ ১৮- সর্গ/৩৩)

অর্থাৎ একবার যে আমার শরণাগত হয়, সর্বপ্রাণীকুল থেকে অভয় দান করাই আমার ব্রত।

অহল্যা যত গর্হিত পাপই করে থাকুন, পাপক্ষয় নিমিত্ত কোন কৃচ্ছ্রসাধন না করলেও শ্রীরামের শরণাগত হওয়ার সাথে সাথেই তাঁর সমস্ত পাপ ধুয়ে মুছে গেছে। শ্রীরামের দর্শন পেয়ে অহল্যা এত পুলকিত হয়েছেন যে, তাঁর পতির দেওয়া অভিশাপকে আশীর্বাদ মনে হয়েছে। তিনি বললেনঃ

“মুনি শ্রাপ জো দীনহা অতি ভল কীনহা
পরম অনুগ্রহ ম্যায় মানা।
দেখেউঁ ভরি লোচন হরিভবমোচন...।।
বিনতী প্রভু মোরি ম্যায় মতি ভোরী নাত ন্ মাঙ্গউবর আনা।
পদকমল পরাগারস অনুরাগা মমমন মধুপ করে পানা।।”
 –(রামচরিত মানস/ বাল কাণ্ড/ ১৮১ পৃঃ)

এই কয়েকটি পদে অহল্যার ভক্তিরস যেন উপচে পড়েছে। অহল্যা বলেছেন, গৌতমমুনি শাপ দিয়ে আমার উপকারই করেছেন। এ শাপের ফলে আমি দু’চোখ ভরে ভববন্ধন মোচনকারী শ্রীরামের দর্শন সৌভাগ্য লাভ করলাম। তাই হে প্রভু, অন্য কোন বর প্রার্থনা করি না – আমার শুধু এইটুকু প্রার্থনা যে, আমার মনভ্রমর যেন সর্বদা তোমার চরণকমলের মধুপানে মত্ত থাকে।

এই কয়েকটি পদে তুলসীদাসজীর সুললিত ছন্দে অহল্যা হয়ে উঠেছেন ভক্তির মূর্ত বিগ্রহ – প্রতি পদে যেন ভক্তিরস উপচে পড়ছে।

তুলসীদাসজী মূলত ভক্তকবি। তাই অহল্যাদেবীর ভক্তির আতিশয্য তাঁকে আবেগাপ্লুত করে তুলেছে। এ কারণে তিনি অহল্যার পূর্বজীবনের দিকে তাকাননি। অহল্যা শাপগ্রস্তা, একথার উল্লেখ করলেও কেন শাপগ্রস্তা, তা নিয়ে মাথা ঘামাননি। বাঙালীকবি কৃত্তিবাস ও হিন্দীকবি তুলসীদাস, উভয়েই ভক্তিরসাশ্রিত কবি। উভয়ের চিন্তাতেই বিষ্ণু অবতার শ্রীরামচন্দ্রের পক্ষে কোন অভিশপ্ত নারীর চরণবন্দনা মর্যাদা হানিকর মনে হয়েছে। তাই ভক্তির আবেগে উভয়েই বাল্মীকির বিপরীত চিত্র এঁকেছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন, অহল্যা প্রথমে শ্রীরাম-লক্ষণের পাদ বন্দনা করছেন। যথা, কৃত্তিবাসে – ‘তোমার মাথায় পদ দিবে নারায়ণ......’ (কৃত্তিবাসী রামায়ণে - পৃঃ ৬৫)

আবার তুলসীদাস ঋষি বিশ্বামিত্রের মুখ দিয়ে বলিয়েছেনঃ “চরণ কমলরজ চাহতি কৃপা করহু রঘুবীর।” অর্থাৎ অহল্যা তোমার চরণধূলি প্রার্থনা করছে, তুমি কৃপা করে ওকে চরণধূলি দাও। বিশ্বামিত্রের নির্দেশে শ্রীরাম প্রস্তরীভূত অহল্যার দেহে চরণ স্থাপন করা মাত্র তপোমূর্তি অহল্যা তাঁর সামনে করজোড়ে সত্যি সত্যিই উঠে দাঁড়ালেন।

কিন্তু আদিকবি এ বিষয়ে কি বলেছেন, শ্রীরামচন্দ্রই  আগে অহল্যার চরণ বন্দনা করেছেন। উপসংহারে বলতে হয়, অহল্যা স্বয়ং ব্রহ্মার মানসকন্যা এবং তপঃসিদ্ধা। তাই তাঁর স্মরণে মহাপাপের নাশ হওয়াই স্বাভাবিক।

* সমাপ্ত *


মহারাণী কুন্তী



আমরা পূর্বে পঞ্চ কন্যার অন্যতম দ্রৌপদী সম্পর্কে জেনেছিলাম। যাঁদের নিত্য স্মরণে মহাপাপ নাশ হয়, সেই পঞ্চকন্যার অপর এক কন্যা- কুন্তী। আমরা মহাভারতের কুন্তীর নাম সকলেই শুনেছি বা জেনেছি। অনেকে তাঁর সম্পর্কে ভালো বলে, অনেকে খারাপ বলে।  কেন তাঁর নিত্য স্মরণে মহাপাপ নাশ হয়  তা আমরা চরৈবেতি, বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনের সৌজন্যে দেখব।

মহারাণী কুন্তী



লেখকঃ – চন্দ্রকিশোর তানেজা



‘অহল্যা, দ্রৌপদী, কুন্তি, তারা মন্দোদরী তথা।
পঞ্চ কন্যাং স্মরেন্নিত্যং মহাপাতক নাশনম্ ।।’

অহল্যা, দ্রৌপদী, কুন্তি, তারা ও মন্দোদরী এই পঞ্চ কন্যার নিত্য স্মরণে মহাপাপ নাশ হয়। উদ্ধৃত শ্লোকে এই কথাই বলা হয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এই শ্লোকে কুন্তীর অন্তর্ভুক্তি নিয়ে। এ প্রসঙ্গে আলোচনা করার আগে আমরা শ্রীমদ্ভাগবতে উল্লিখিত মহারানী কুন্তীর মুখে গোবিন্দের স্তুতিটি শুনে নিই। কি অনবদ্য মর্মস্পর্শী ভাষায় কুন্তী দেবী গোবিন্দের স্তুতি করেছিলেন, শুনলে ভক্তমাত্রেরই রোমাঞ্চ হয়। স্রীমদ্ভাগবতে এইভাবে উল্লিখিত আছেঃ

কন্ত্যুবাচ্য (কুন্তী বললেন) –
‘নমস্যে পুরুষং ত্বামাদ্যমীশ্বরং প্রকৃতেঃ পরম্।
অলক্ষ্যং সর্ব ভূতানামন্তর্বহিরবস্থিতম্।।’
****
‘কৃষ্ণায় বাসুদেবায় দেবকী নন্দনায় চ।
নন্দ গোপকুমারায় গোবিন্দায় নমোনমঃ।।’
****
‘বিপদঃ সন্তু নঃ শশ্বত্তত্র তত্র জগদগুরো ভবতো দর্শনম্।
যৎ স্যাদ পুনর্ভবদর্শনম্।।’
****
‘নমোহকিঞ্চন বিতায় নিবৃত্তগুণবৃত্তয়ে।
ত্বামাত্মরামায় শান্তায় কৈবল্যপতয়ে নমঃ।।’

সংক্ষেপে ভাবানুবাদঃ সর্বজীবের অন্তর বাহিরে অলক্ষ্যচারী ইন্দ্রিয়াতীত আদ্যপুরুষ হে ঈশ্বর, হে কৃষ্ণ, হে গোবিন্দ, হে দরিদ্রের সম্পদ! তোমাকে পুনঃ পুনঃ নমস্কার। বিপদ আমদের চিরস্থায়ী হোক, আর হোক তোমার ভূয়োদর্শন, যার ফলে হবে এ ভবের চির অদর্শন।
গোবিন্দের এই স্তুতিতেই কুন্তীচরিত্রের অলোকসামান্য মহিমা ফুটে উঠেছে। কুন্তীচরিত্রের অন্যান্য দিকে আলোকপাত না করে শুধু এই স্তুতির আলোকে দেখলেই বোঝা যায়, কুন্তী কী মহিমময়ী নারী। কৃষ্ণের প্রতি গভীর ভালোবাসার কাছে রাজৈশ্বর্যপ্রীতি তুচ্ছ হয়ে গেছে। কৃষ্ণের প্রতি গভীর প্রেমবশত বিপদকে চিরসঙ্গী করে নিতে তাঁর কোন কুণ্ঠা নেই। তিনি প্রার্থনা করেছেন, বিপদ থাকুক। কেননা, বিপদ থাকলেই কৃষ্ণ থাকবেন। যখনই বিপদ দেখা দেবে, তখনই বিপদভঞ্জন গোবিন্দের আবির্ভাব হবে। তাঁর জীবনে বিপদ অজস্র এসেছে, গোবিন্দের আবির্ভাবও অজস্রবার হয়েছে। তাই তাঁর স্থির বিশ্বাস জন্মেছে, বিপদদর্শনের সাথে সাথে গোবিন্দের দুর্লভদর্শন অবশ্যম্ভাবী। এভাবে পুনঃ পুনঃ গোবিন্দদর্শনের ফলে, এ সংসারদর্শন আর হবে না – হবে চিরমুক্তি। এই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়েই কুন্তী গোবিন্দের নিত্যসাহচর্য কামনা করে দুঃখ-দৈনকে আলিঙ্গন করতে চেয়েছেন। তাই গোবিন্দকে ‘অকিঞ্চন বিত্ত’ বলে সম্বোধন করেছেন। অকিঞ্চন যার কিছু নেই, তাঁর বিত্ত(ঐশ্বর্য) স্বয়ং গোবিন্দ। মহারাণী পাণ্ডবজননী কুন্তীর মহিমমিয়ত্বের রহস্য এখানেই নিহিত আছে। তাঁর বিরুদ্ধে উচ্চারিত সমস্ত অপবাদ কুৎসাকে ছাপিয়ে তাঁর অকিঞ্চন বিত্ত গোবিন্দ প্রীতি তাঁকে মহারণী থেকে মহাদেবীতে উন্নীত করেছে। এবার কুন্তী চরিত্রের অন্যান্য দিকগুলির দিকে দৃষ্টিপাত করে সামাজিক দৃষ্টিতে কুন্তীর অবস্থানটা পর্যালোচনা করা যাক।
শুধু এ যুগেই নয়, সুদূর মহাভারতের যুগেও সামাজিক দৃষ্টিতে কুন্তীর চরিত্র নিন্দনীয় ছিল। একথা সকলেরই জানা যে, কুন্তী কানীন পুত্র কর্ণের জননী। কন্যা অবস্থায় সন্তান ধারণ এ যুগের মত সেযুগেও একইরকম নিন্দনীয় ছিল। খুব স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন ওঠে, সামাজিক দৃষ্টিতে নিন্দার পাত্র কোন ব্যক্তির স্মরণে কেন মহাপাপ নাশ হবে। এ প্রশ্নের উত্তর খুব সতর্ক ভাবে দিতে হবে।
প্রথমে জানা দরকার, কে এই কুন্তী। কুন্তী হচ্ছেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের পিতা বসুদেবের ভগিনী। অতএব শ্রীকৃষ্ণের পিসিমা। ইনি ভোজরাজের কন্যা এবং কুরুরাজ পাণ্ডুর পত্নী। যুধিষ্ঠিরাদি পাণ্ডবগণের গর্ভধারিণী। কর্ণের গর্ভধারিণী হলেও তা ছিল অপ্রকাশিত। কুন্তী কিভাবে কানীন পুত্রের জননী হলেন, এ প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধেয়। দেখা যাক্ কুন্তীর কন্যাকালে কি ঘটনা ঘটেছিল। শ্রীকৃষ্ণের পিতামহ শূর যাদব। তাঁর কন্যা পৃথা বা কুন্তী। শূর তাঁর পিসতুতো ভাই রাজা কুন্তীভোজকে নিঃসন্তান দেখে করুণাপরবশ হয়ে তাঁর হাতে পৃথাকে সমর্পণ করলেন। পৃথাকে তিনি কন্যার মত পালন করেন। পরে কিশোরী বয়সে তাঁর ওপর অতিথি সৎকারের ভার অর্পণ করেন। পৃথা অত্যন্ত নিষ্ঠা সহকারে অতিথিসেবা করতে থাকলেন। মহর্ষি দুর্বাসা তাঁর সেবায় তুষ্ট হয়ে স্বেচ্ছায় তাঁকে একটি মন্ত্রদান করেন। মন্ত্রের বৈশিষ্ট্য হল, যে দেবতাকে স্মরণ করে ঐ মন্ত্রজপ করা হবে, সেই দেবতা তৎক্ষণাৎ জপকারীর সম্মুখে আবির্ভূত হবেন। অনভিজ্ঞা বালিকা কৌতূহলী হয়ে মন্ত্রশক্তি পরীক্ষা করে দেখার জন্য সূর্যদেবতাকে স্মরণ করলেন। সূর্যদেব তৎক্ষণাৎ আবির্ভূত হলেন। বালিকা হলেও তাঁর বুঝতে অসুবিধা হল না যে, কিছু একটা অঘটন ঘটতে চলেছে। তিনি সূর্যদেবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। তিনি বললেন যে, তিনি বালিকা, কোন অপকর্ম করলে সংসারে তাঁর অপযশ রটবে। কিন্তু সূর্যদেব তাঁকে আশ্বস্ত করে তাঁর গর্ভে সন্তান স্থাপন করে গেলেন। কর্ণের জন্ম হল।
এ ঘটনায় কুন্তীর দোষ কোথায়? এক অবোধ বালিকাকে মহর্ষি বর দিলেন একটি মন্ত্র দিয়ে, যা জপ করলে দেবতার আবির্ভাব ঘটবে। বালিকার কৌতূহলী হওয়া অস্বাভাবিক নয়, স্বাভাবিক। মন্ত্র পরীক্ষা করতে গিয়ে এরকম অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটবে, তাও তাঁর জানা ছিল না। অপরিকল্পিত আকস্মিক ঘটনা কখনোই দোষ বা পাপের কারণ হতে পারে না। যে ঘটনা ঘটেছিল, তাতে কুন্তী সম্পূর্ণ নির্দোষ। তাই তাঁকে কোন পাপ স্পর্শ করেনি।
কুন্তীর বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অভিযোগঃ তিনি মা হয়ে অনাথ শিশুকে জলে ভাসিয়ে দিলেন কি করে? তিনি সন্তান হত্যার পাপে পাপী, একথা কি অস্বীকার করা যায়? এটি একটি গভীর মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক প্রশ্ন। পাঁচ হাজার বছর আগেকার মহাভারতের যুগ, আর এই একুশ শতকের সভ্যযুগের মধ্যে কতখানি সামাজিক পার্থক্য ঘটেছে, একটু অনুসন্ধান করা যাক্।
মহাভারতের সেই বর্বরতার যুগেও যেমন সমাজের চোখরাঙানির ভয় ছিল, এই একবিংশ শতকেও সমাজের অবস্থানের কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সামাজিকভাবে চোখে পড়ে না। এখনো ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে অবাঞ্ছিত সন্তানকে হত্যা করে ফেলা হয়। তার থেকেও বড় কথা, পূর্ণবয়স্ক ছেলে বা মেয়ে সমাজের শাসনকে উপেক্ষা করে অবাঞ্ছিত ব্যক্তির সঙ্গে মেলামেশা করলে, সমাজপতিরা, এমনকি মা-বাবাও নিজের সন্তানকে বলি দেয়। সন্তানের থেকে সমাজ বড় হয়ে দেখা দেয়, মায়ের বুক খালি হয়ে গেলেও।
পাঁচ হাজার বছর আগেকার, দুর্যোধন, দুঃশাসন, শকুনি ও কর্ণের সেই বর্বর যুগ থেকে আমরা কতখানি এগিয়েছি? এই প্রশ্নের আলোকে কুন্তীর বিচার করা যাক্। এক অবোধ বালিকা, এক আকস্মিক অনভিপ্রেত ঘটনার শিকার। তৎকালীন সমাজ ছিল অসভ্য, বর্বর – যে সভায় প্রকাশ্য পুত্রবধূকে বিবস্ত্র করার চেষ্টায় কেউ বাধা দেয় না – বৃদ্ধেরা হেঁটমুণ্ডে বসে থাকেন। এ সেই সময় সেই সমাজ, যখন কুন্তী অনভিপ্রেত ঘটনার শিকার হয়েছিলেন। সেই বীভৎস ঘৃণ্য সময়ের সমাজে লোকজুগুপ্সার ভ্যে কুন্তী দেবী যা করেছিলেন, তা আপাতদৃষ্টিতে দোষবহ হয়ে থাকলেও, বয়েসের বিচারে সে দোষ ধর্তব্য নয়। এক অপরিণত শিশু ভয়ে যা করে বসে সে কাজ গর্হিত হলেও ক্ষমার্হ। অতএব কুন্তীদেবী সন্তান বিসর্জন দিয়ে যে অপরাধ করেছিলেন, তা বালোচিত ভীতি থেকেই উদ্ভূত বলেই গণ্য করা যায়। কুন্তীদেবীর বিরুদ্ধে যে পাপের কথা আমরা কল্পনা করি, তা খণ্ডিত হল। এবার কুন্তীদেবীর স্মরণে কেন পাপ নাশ হয়, তা আগামী পর্বে আলোচনা করা হবে।

আমরা জানি কুন্তী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পিসিমা। এই সম্পর্কের জন্যই কুন্তী আমাদের নমস্যা। কিন্তু শুধু সম্পর্কের জোরে ব্যক্তিবিশেষে দোষগুণ আরোপিত হয়না। সেই দৃষ্টিতে মথুরারাজ কংসও শ্রীকৃষ্ণের মামা। কিন্তু ভগবানের মামা হওয়ার সুবাদে মহারাজ কংসে ভগবত্ব আরোপিত হয়নি। কংস জগতে নিন্দনীয় মামার দৃষ্টান্ত হিসাবেই থেকে গেছে। তাই শ্রীকৃষ্ণের মামা হওয়ার সুবাদে কংসের স্মরণে পাপমোচন হয় না, বরং পাপবৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে। অতএব সম্পর্কের সুত্র ধোপে টেকে না।
এবার দেখা যাক্ মহারাণী কুন্তীর আর কী গুণ ছিল, যার অনুস্মরণে ও অনুসরণে মানুষের চিত্তভূমি পবিত্র হয়ে পাপ মুক্ত হতে পারে। কুন্তীদেবীর জীবনচরিত প্রথম থেকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, একেবারে শৈশবে কুন্তী বা পৃথ্বা তাঁর পালকপিতার নির্দেশে অতিথি সেবায় নিযুক্ত ছিলেন। তিনি নিষ্ঠাবতী। অত্যন্ত নিষ্ঠা সহকারে মহর্ষি দুর্বাসার সেবা করে তাঁকে তুষ্ট করেছিলেন। সেবার সাথে তাঁর ছিল শ্রদ্ধা ও বিনয়। তাঁর আন্তরিক সেবা, শ্রদ্ধা ও বিনয় দুর্বাসার মত স্বভাবের ঋষিরও হৃদয় বিগলিত করেছিল। তাঁর চরিত্রের এই মাধুর্যের জন্যই তিনি স্মরণীয়া। মহর্ষি দুর্বাসার আশীর্বাদধন্যা বলে দুর্বাসার শক্তি ও তেজ তাঁর মধ্যে স্বতঃসঞ্চারিত। শুধু একারনেই কুন্তী মহীয়সী ও তাঁর স্মরণে-মননে মহাপাপেরও বিনাশ হতে পারে।
আরো এক ক্ষেত্রে কুন্তী চরিত্রের দৃঢ়তা ও সংযম অনুসন্ধানীর নজরে পড়ে। অপরিণত বয়েসে অন্তঃসত্ত্বা হয়েও তিনি আত্মহত্যা বা ভ্রূণ হত্যার পথ বেছে নেননি, যা খুব স্বাভাবিক ছিল। এই সভ্য যুগেও এধরনের ঘটনা আকছার ঘটে যাচ্ছে। কিন্তু ঐটুকু মেয়ে ঐ বর্বর যুগে অনেক লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করেও সন্তানকে গর্ভে পোষণ করেছেন ও প্রসব করেছেন। কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারেননি। ঐটুকু মেয়ের আর কতটুকুই বা সাহস থাকতে পারে! সমাজের রক্তচক্ষুর ভয়ে সন্তান কে জলে ভাসিয়ে দিলেও পরম মমতায় তার জীবন রক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন।
মানবজীবনের যা শ্রেষ্ঠ সম্পদ- ইন্দ্রিয় সংযম, তার চরম পরীক্ষা কুন্তীদেবী দিয়েছেন। মৃগয়া প্রিয় রাজা পাণ্ডু জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ধৃতরাষ্ট্রের হাতে রাজ্যভার অর্পণ করে দুই পত্নী কুন্তী ও মাদ্রী সহ বনে বাস করতে লাগলেন। ঐ সময় মহারাজ পাণ্ডু মৃগয়ারূপধারী কিন্দম নামে এক ঋষিপুত্রের ওপর বাণাঘাত করলে কিন্দম কর্তৃক অভিশপ্ত হন। কিন্দম অভিশাপ দেন, মহারাজ স্ত্রী শরীর স্পর্শ করামাত্র মৃত্যুমুখে পতিত হবেন। বিষণ্ণ মহারাজ প্রতিজ্ঞা করলেনঃ

‘একাকী হইয়া পৃথ্বী করিব ভ্রমণ।
সকল ইন্দ্রিয়গণে করিব দমন।।’ – কাশীদাসী মহাভারত

অতঃপর রাজা কুন্তী ও মাদ্রীকে হস্তিনাপুরে ফিরে যেতে আদেশ করলেন। তাঁরা কোনমতেই রাজাকে ছেড়ে হস্তিনাপুরে ফিরে যেতে রাজি হলেন না। তখন রাজার আদেশে তাঁরা বসন-ভূষণ ত্যাগ করে সন্ন্যাসীবেশ ধারণ করলেন। তথাপি শেষরক্ষা হল না। কুন্তী যথেষ্ট সংযমের পরিচয় দিলেন। কিন্তু মাদ্রী সংযম রক্ষা করতে পারলেন না। মুহূর্তের জন্য সংযম ভ্রষ্ট হওয়ার ফলে পাণ্ডুর মৃত্যু হল। সংযম ভঙ্গের ব্যাপারে কুন্তীর কিছুই জানা ছিল না। কুন্তীর অজ্ঞাতসারে পাণ্ডু ও মাদ্রী দূরে বনে চলে যান। সেখানেই পাণ্ডুর মৃত্যু হয়। সবকিছু জানতে পেরে কুন্তী মাদ্রীকে তিরস্কার করেন। কিন্তু নিজে কখনো কোন প্রকার অসংযম প্রকাশ করেননি। পাণ্ডুর মৃত্যু হলে মাদ্রী সহমৃতা হন। তাঁর দুই পুত্র নকুল ও সহদেবকে কুন্তীর হাতে তুলে দেন। কুন্তী অপত্য নির্বিশেষে মাদ্রীর দুই পুত্রকে পালন করেন। তাঁর স্বীয় গর্ভজাত সন্তান ও মাদ্রীর গর্ভজাত সন্তানের মধ্যে কখনো ভেদদৃষ্টি রাখেননি। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে কুন্তীকে মহীয়সী বলতেই হবে। সতীনের সন্তানকে আপন সন্তানের মত পালন করার দৃষ্টান্ত ইতিহাস পুরাণেও নেই। বাস্তব জীবনে তো অনেক দূরের কথা। তাঁর চিত্তের ঔদার্য অনুস্মরণীয়।
একবার ঘটনাক্রমে শ্রীকৃষ্ণ বিদুরের গৃহে উপস্থিত হলেন। বিদুরের অনুপস্থিতিতে কুন্তী তাঁর অভ্যর্থনা করলেন। কুন্তীদেবী শ্রীকৃষ্ণকে দেখে সানন্দে তাঁর মস্তক চুম্বন করলেন। স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কুন্তী দেবীর দু’পা ধরে প্রণাম করলেন। যে গোবিন্দ ভক্তেরা ধ্যানে পায় না, সেই গোবিন্দ কুন্তী দেবীর চরণযুগল বন্দনা করছেন। এ কি কম কথা! সেই কুন্তীর স্মরণে পাপক্ষয় হবে, এতে বৈচিত্র কী!
কুন্তী রাজনন্দিনী রাজকুলবধূ। কিন্তু কি দুঃখই না সারাজীবন পেয়েছেন। পৃথিবীর ন্যায় সর্বংসহা। তাঁর জীবনে নেমে এল অকাল বৈধব্য। হস্তিনাপুরে অনাথ বালকদের হাত ধরে আসা তাঁর পুত্রগণের প্রতি জ্ঞাতিভ্রাতাদের হিংসা, ভীমকে বিষ খাওয়ানো ইত্যাদি নানাবিধ হিংসায় তাঁর কোমল মাতৃহৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করেছিল। অবশেষে পাণ্ডবকুলকে নিঃশেষে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে তাঁদের বারাণাবতে প্রেরন। সেখান থেকে কৌশলে পালিয়ে বনে বনে ঘুরে বেড়ানো, পঞ্চপুত্র নিয়ে হিড়িম্ব অরণ্যে প্রবেশ, অবশেষে ব্যসদেবের উপদেশে একচক্রা নগরে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বনে জীবিকানির্বাহ – এসব দুঃখ কুন্তীদেবী মুখবুজে সহ্য করেছেন। ঐ একচক্রা নগরেই আশ্রয়দাতা ব্রাহ্মণ পরিবারে শোকের কারন জানতে পেরে নিজের প্রিয় পুত্র ভীমকে রাক্ষসের মুখে পাঠানো, পরপুত্রের প্রাণ রক্ষার্থে স্ব-পুত্রের উৎসর্গ -এগুলি তাঁর দেবদুর্লভ চরিত্রের পরিচায়ক। যদিও কুন্তীর বিশ্বাস ছিল, তাঁর পুত্র ভীম রাক্ষসকে মেরে শুধু ঐ ব্রাহ্মণের পুত্রকেই নয়, গোটা গ্রামকেই রাক্ষসের ভয় থেকে মুক্ত করবে, তথাপি কোন মা-ই বা পরপোকারার্থে নিজসন্তানকে সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে! যাই হোক ইতিমধ্যে পাঞ্চালনগরে পাঞ্চালীর স্বয়ংবর বার্তা শুনে কুন্তী দেবীর পাঁচ পুত্র স্বয়ংবর সভায় যাওয়ার জন্য উৎসুক হয়ে উঠলেন। কুন্তী পুত্রগণের মনোভাব আঁচ করে বললেন, ‘একচক্রা নগরে ভুদিন বাস হল, একস্থানে বেশীদিন বাস উচিতও নয়। তাছারা এখানে আগের মত ভিক্ষাও পাওয়া যায় না। শুনেছি, পাঞ্চালরাজ বড়ই দয়ালু। অতএব তোমাদের আপত্তি না থাকলে, চলো আমরা পাঞ্চালরাজ্যে যাই।’ মায়ের এ প্রস্তাব সকলে মাথা পেতে নিলেন। এরপর কুন্তীসহ পঞ্চপাণ্ডব পাঞ্চালের পথে যাত্রা করলেন। পাঞ্চালে গিয়ে তাঁরা এক কুম্ভকারের গৃহে আশ্রয় নিলেন। সেখানেও পাঁচ ভাই ব্রাহ্মণের বেশে ভিক্ষা করেন। আর সারাদিন পাণ্ডবজননী কুন্তীদেবী পরাশ্রয়ে অনাহারে নিঃসঙ্গ বসে থাকেন পুত্রগণের ভিক্ষার অপেক্ষায়। ভাবলে অবাক হতে হয়, ইনি কি মানবী না দেবী! এত সহিষ্ণুতা, এত ধৈর্য – এ কি মনুষ্য শরীরে সম্ভব? হ্যাঁ, এ অসম্ভব সম্ভব হয়েছিল বলেই তাঁর স্মরণে মহাপাপ নাশ হয়।
দুর্বিসহ দুঃখের মধ্যে দিয়েই কুন্তীর পথ চলা। দুঃখের আগুনে পুড়তে পুড়তে তাঁর অন্তরের সমস্ত খাদ গলে যাওয়ায় তিনি নিখাদ সোনায় পর্যবসিত হয়েছিলেন। তিনি শ্রীকৃষ্ণকে সকল দুঃখের ত্রাতারূপে পেয়েছিলেন। এ ভাবেই তাঁর শ্রীকৃষ্ণে ভালবাসা জন্মেছিল। সেই ভালবাসাই গাঢ় হয়ে ভক্তিতে পরিণত হয়েছিল। বহু দুঃখের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই তিনি শ্রীকৃষ্ণকে ভগবানরূপে চিনতে পেরেছিলেন। অন্তিমে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তাঁর ভালবাসা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, তিনি কৃষ্ণবিরহ অপেক্ষা নিজ জীবনে দুঃখকেই শ্রেয় বলে মনে করেছিলেন।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ। যুধিষ্ঠির হস্তিনাপুরের রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভাবলেন, তাঁর কর্তব্য শেষ। এবার তিনি দ্বারকায় ফিরবেন। সকলের কাছেই প্রণাম বন্দনা, স্নেহ- বাৎসল্য জানিয়ে বিদায় নিলেন। কিন্তু পিসিমা কুন্তীর কাছে বিদায় নিতে গিয়েই প্রমাদ ঘটল। কুন্তীর রথে চাকা ধরে বাধা দিয়ে বললেনঃ
“আজ আমি রাজমাতা – অনন্ত ঐশ্বর্য আমার করতলগত। কিন্তু হে কৃষ্ণ, এ ঐশ্বর্য, এ সুখ আমি চাইনা। সুখের মধ্যে থাকলে, বিলাসের মধ্যে থাকলে তোমাকে ভুলে যাব- তুমিও আমাদের ভুলে যাবে। যাতে তোমার বিস্মরণ হয়, তোমার অদর্শন হয়, সে অবস্থা আমি চাই না। বরং তুমি থাকো, আমার নিত্য দুঃখ দৈন্যের সঙ্গী হয়ে। দুঃখ দৈন্যের মাঝে তোমার পুনঃ পুনঃ স্মরণ হবে, আর হবে তোমার ভুয়োভূয়ঃ দর্শন – যাতে করে হবে এ সংসারের আবর্ত থেকে চীরমুক্তি। তাই তিনি বলেছেন – ‘বিপদঃ সন্তু নঃ শশ্বত্তত্র তত্র জগদ্গুরো ভবতো দর্শনম্। যৎ স্যাদপুনর্ভবদর্শনম্’ – বিপদ আমাদের চীরস্থায়ী হোক।”
সারাজীবন দুঃখের আগুনে পুড়ে কুন্তী হয়েছেন নির্লোভ, অনাসক্ত। তাঁর মধ্যে দৈবীসম্পদের সুস্পষ্ট লক্ষণ ফুটে উঠেছে তাঁর শেষ জীবনে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষে যুধিষ্ঠির রাজা হলেন। ব্যাস তাঁকে পরামর্শ দিলেন অশ্বমেধ যজ্ঞ করার। তাঁর পরামর্শ অনুসারে বহু ব্যয় ও পরিশ্রমসাধ্য অশ্বমেধ যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হল। যজ্ঞ সুসম্পন্ন হলে মহারাজ যুধিষ্ঠির যজ্ঞের দক্ষিণাস্বরূপ অর্জুন-বিজিত সমস্ত রাজ্য ব্যাসদেবকে অর্পণ করলেন। কিন্তু ব্যাসদেব রাজ্যের পরিবর্তে ধনসম্পদ আকাঙ্ক্ষা করলেন। পড়ে মহর্ষি ব্যাসদেব দক্ষিণারূপে প্রাপ্ত সমগ্র ধনরাশি কুন্তী দেবীকে দান করলেন। কুন্তীদেবীর না আছে ধনৈশ্বর্যে লোভ, না ভোগে আসক্তি। তিনি ঐ ধন নানা সৎকর্মে ব্যয় করলেন। যিনি বহু দুঃখের মধ্য দিয়ে জীবন নির্বাহ করেছেন, দীর্ঘদিন দারিদ্রের সঙ্গে সংগ্রাম করেছেন, ধনৈশ্বর্যে লোভ হওয়া তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক। কিন্তু কুন্তী সত্যিই দেবী। তাই তিনি ঐ সম্পদ নিয়ে বিলাসব্যসনে গা ভাসিয়ে না দিয়ে সৎকার্যে ব্যয় করলেন।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর পনেরো বছর কেটে গেছে। কুন্তী এখন রাজমাতা। তাঁর সুখৈশ্বর্যের কোন ত্রুটি ছিল না। তথাপি সংসারসুখে নির্লিপ্ত কুন্তী অনায়াসেই অন্ধ রাজদম্পতির সঙ্গে বানপ্রস্থ অবলম্বন করে বনবাসিনী হলেন। যুধিষ্ঠিরাদি পুত্রগণ তাঁকে ফিরিয়ে আনার জন্য অনেক অনুনয় বিনয় করলেন। কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কুন্তীকে টলানো গেল না।
ধৃতরাষ্ট্রদের সঙ্গিনী হয়ে কুন্তী ব্যাসের আশ্রমে উপস্থিত হলেন। ব্যাসদেব উপদেশে তাঁরা সকলেই কঠোর তপস্যায় ডুবে গেলেন। পড়ে কোন এক সময়ে নারদের মুখে জানা গেল- ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী দাবানলে দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন। কুন্তীদেবীর মৃত্যুও বানপ্রস্থে দীর্ঘ তপস্যার পর স্বাভাবিক অগ্নিতে হয়। দেবর্ষির কথানুসারে তিনি বিহিতাগ্নি প্রাপ্ত হয়েছেন। অতএব তিনি পুন্যবতী, এ বিসয়ে কোন সংশয় থাকে না।
কুন্তী চরিত্রের আরো একটা দিক বিশ্লেষণ না করলে তাঁর চরিত্র বিশ্লেষণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাই এবার আমরা জননীরূপিণী কুন্তীর দিকে আলোকপাত করতে চাই। কুন্তী রত্ন প্রসবিনী – যুধিষ্ঠিরাদি তিন পুত্রের গর্ভধারিণী। উপযুক্ত ক্ষেত্র না পেলে মহান গুনবান-পুন্যবানরা জন্মগ্রহণের সুযোগ পান না, একথা স্বামী পরমানন্দ বলেছেন। জগতের মহাপুরুষগণের জীবনী পর্যালোচনা করলেও এ কথার সত্যতা প্রমাণিত হয়। মর্যাদা পুরুষ শ্রীরামচন্দ্র, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, মা সারদা, স্বামী বিবেকানন্দ, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর – এঁরা সকলেই মহীয়সী মায়ের মহান সন্তান। জননী কুন্তী একাধিক মহান সন্তানের গর্ভধারিণী- এদিক থেকে বিচার করলে কুন্তী মহীয়সী অপেক্ষা মহত্তরা।
পরিশেষে, কুন্তী চরিত্রের সামগ্রিক বিচার করলে, আমরা তাঁর অবুঝ বাল্যকালের নিরুপায় স্খলন ছাড়া অন্য বিচ্যুতি খুঁজে পাইনা। পরিণত বয়স্কা কুন্তী সর্বাংশে নিখুঁত- স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল। এই কুন্তী সত্যি সত্যিই দেবী – মনুষ্যবিরল, দেবদুর্লভ চরিত্রের অধিকারিণী। সর্বোপরি, কুন্তী একান্ত কৃষ্ণভক্ত। ভক্তের হৃদয়েই ভগবানের বাস।

‘নাহং বসামি বৈকুণ্ঠে যোগিনাং হৃদয়ে নৈব চ।
মদ্ভক্তা যত্র গায়ন্তি তত্র তিষ্ঠামি নারদ।’

- আমার ভক্ত যেখানে আমার নামগান করে, আমাকে স্মরণ করে আমি সেখানেই থাকি। ভক্তের স্মরণে স্বভাবিকভাবেই ভগবানের স্মরণ হয়। এবার নিঃসংশয়ে বলা যায় যে, ভগবদ্ ভক্ত কুন্তীর স্মরণে মহাপাপের নাশ হয়।