আমরা রামায়নে অহল্যার নাম সকলেই শুনেছি।
গৌতমমুনির স্ত্রী ছিলেন অহল্যা। স্বামীর শাপে পাষাণে পরিণত হয়ে গিয়েছেলেন।
দীর্ঘকাল এভাবে থাকার পর ভগবান শ্রীরামচন্দ্র তাঁকে মুক্তি দেন। এটাই ছিল দু-এক
লাইনে অহল্যার চরিত্র। তিনিও ছিলেন পঞ্চকন্যার অন্যতম, আমরা পুনরায় সেই শ্লোকটি
দেখে নিই-
‘অহল্যা, দ্রৌপদী,
কুন্তি, তারা মন্দোদরী তথা।
পঞ্চ কন্যাং
স্মরেন্নিত্যং মহাপাতক নাশনম্ ।।’
অহল্যা, দ্রৌপদী, কুন্তি, তারা ও মন্দোদরী এই পঞ্চ কন্যার
নিত্য স্মরণে মহাপাপ নাশ হয়। কেন তাঁর নিত্য
স্মরণে মহাপাপ নাশ হয় তা আমরা দেখব, এবং যার জন্য
দেখতে পাব সেটি অবশ্যই বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনের “চরৈবেতি”।
তপস্বিনী অহল্যা
স্বয়ং ব্রহ্মা অহল্যা নামক সুন্দরী সৃজন করে ইন্দ্রকে
বললেনঃ
“ততো ময়া রূপৈগুণৈরহল্যেতি নির্মিতা।
হলং নামেতি বৈরূপ্যং হল্যং তৎপ্রভবং ভবেৎ।।” (বাল্মীকি
রামায়ণ/ বালকাণ্ড)
অর্থাৎ রূপে-গুণে অতুলনীয়া অহল্যা নামে রমণী আমি সৃষ্টি
করেছি। ‘অহল্যা’ নাম কেন, তাঁর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বললেনঃ ‘হল্য’ শব্দের অর্থ
বিকৃতি। অতএব যে নারীর মধ্যে রূপে বা গুণে কোন বিকৃতি নেই, তিনিই অহল্যা। এর থেকে
বোঝা যায়, অহল্যা সর্বাঙ্গ সুন্দরী। শুধু রূপে নয়, গুনেও তিনি সবার সেরা। বাঙালী
কবি কৃত্তিবাস অহল্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেনঃ
“সহস্র সুন্দরী সৃষ্টি করিলেন ধাতা।
সৃজিলেন তা সবার রূপেতে অহল্যা।
ত্রিভুবনে সৌন্দর্যে না ছিল তার তুল্যা।।”
কবি বলতে চেয়েছেন ব্রহ্মা সহস্র সুন্দরীর রূপ একত্র করে পরম
রমণীয় এক রমণী সৃষ্টি করলেন, যার নাম অহল্যা। এই অহল্যা পরবর্তীকালে শাপগ্রস্তা
হয়েছিলেন। শাপগ্রস্তা অহল্যাকে হিন্দীকবি সন্ত তুলসীদাস ও বাঙালীকবি কৃত্তিবাস
উভয়েই পাষাণ দেহধারী বলে বর্ণনা করেছেন। যথা, সন্ত তুলসীদাসের ‘শ্রীরামচরিত-মানস’
-এ পাইঃ
‘গৌতমনারি শ্রাপবস উপলদেহ ধরি ধীর’ – এর অর্থ- গৌতমের পত্নী
অহল্যা শাপবশত প্রস্তর দেহধারণ করে ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করে আছেন।
আবার, কবি কৃত্তিবাস বলেছেনেঃ
“অহল্যাকে শাপিলেন ক্রোধে মুনিবর।
শাপ দিনু তোর তনু হউক প্রস্তর।।”
স্বয়ং বাল্মীকি প্রস্তরদেহের কথা বলেননি। বাল্মীকি রামায়ণে
অহল্যার প্রতি গৌতমমুনির শাপের কথা এভাবে বলা হয়েছেঃ
‘ভার্যামপি শপ্তবান্।
ইহ বর্ষ সহস্রাণি বহূনি নিবসিষ্যসি।।
বাতভক্ষা নিরাহারা তপ্যন্তী ভস্মশায়িনী।
অদৃশ্যা সর্বভুতানামাশ্রমেহস্মিন্ বসিষ্যসি।।’-- (বাল্মীকি
রামায়ণ/ বালকাণ্ড, ৪৮ তম সর্গে, ৩৯ নং শ্লোক)
বাংলায় এর সরলার্থ হলঃ গৌতমমুনি স্বপত্নী অহল্যাকে এই বলে
শাপ দিলেনঃ তুমি এই আশ্রমে ভস্মশায়ী হয়ে (ছাই-এর গাদায় শুয়ে) সকলের অলক্ষ্যে বহু
হাজার বছর তপস্যা কর। তপস্যাকালে কেবলমাত্র বায়ুই তোমার আহার হবে। গৌতমের অভিশাপ
বাণী থেকে স্পষ্ট, তিমি অহল্যাকে নিষ্প্রাণ পাষাণে পরিণত করার অভিশাপ দেননি।
তবে পরবর্তী দুই কবির কল্পনায় অহল্যা কেন পাষাণ দেহধারী
হলেন, তাঁর কারণানুসন্ধান প্রয়োজন।
আমাদের মনে হয়, অহল্যার পাষাণ হওয়ার গল্প রূপক মাত্র। কারণ
দীর্ঘকাল বায়ুমাত্র আহার করে একাগ্রচিত্তে তপস্যায় মগ্ন থাকার ফলে তাঁর দেহ
অস্থিচর্মসার হয়ে গিয়েছিল, সে দেহে বাহ্য চেতনারও প্রকাশ ছিল না। তাই ঐ দেহকে জড়
পাষাণের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। যদিও তাঁর অন্তশ্চেতনা ছিল। এ এক প্রকারের সমাধি।
যুক্তিবাদীরা একে গাঁজাখুরি গল্প বলে উড়িয়ে দিতে পারেন।
আমরা সবিনয়ে জানাতে চাই, আধুনিক যুগেও এরকম ঘটনা ঘটে থাকে। বিজ্ঞানী আচার্য
জগদীশ্চন্দ্র বসু তাঁর ‘অব্যক্ত জীবন’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, বাইরে প্রাণের প্রকাশ
না থাকলেও ভিতরে চেতনা থাকে। ঐ প্রবন্ধে তিনি জনৈক সাধুর উল্লেখ করেছেন, যাকে
লোহার বাক্সে বন্ধ করে মাটির গর্তে পুঁতে দেওয়া হয়েছিল। তিন দিন পড়ে যখন তাঁকে
তোলা হল, তখন তাঁর দেহে প্রাণ ছিল- যাকে লেখক অব্যক্ত জীবন বা latent life বলেছেন। বাইরের আলো-বাতাসের সংস্পর্শে ঐ সাধু
পুনরায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন।
বায়ুমাত্র আহার করে দীর্ঘকাল বেঁচে থাকা যায় কিনা, এ সংশয়
নিরসনের উদ্দেশ্যে আমরা স্বামী বিবেকানন্দের স্বচক্ষে দেখা পওহারী বাবার স্মরণ
করতে চাই। পওহারী কথাটা এসেছে পবন আহারী থেকে। পবন (বায়ু) আহার যার, তিনিই পওহারী।
তার প্রমান মহামহোপাধ্যায় গোপীনাথ কবিরাজের লেখা মানুষ যে
‘পাষাণ’ হয়ে যায় তা ‘জ্ঞানগঞ্জ’ বই-এ পাওয়া যায়। জ্ঞানগঞ্জে বহু সাধক হাজার হাজার
বছর ধরে একাসনে বসে তুষারাকৃতি হয়ে গেছেন। কিন্তু চেতনা হারাননি। পরম পুজনীয় গুরুজী
পরমানন্দ স্বামী এরকম দু’জন সাধকের সাক্ষাৎ পেয়েছেন। এঁদের মধ্যে একজন বাবাজী
মহারাজ, যিনি স্ফটিকদেহ থেকে ওঁ নমঃ শিবায় মন্ত্রে সচল মনুষ্যরূপে আবির্ভূত
হয়েছিলেন। গুরুজী ধ্যানযোগে জেনেছিলেন, সাধনশক্তি ও যোগবিভূতির সাহায্যে বাবাজী
মহারাজ প্রায় চার হাজার বছর ঐ একই শরীরে বিদ্যমান।
দ্বিতীয় জন বৌদ্ধ শ্রমণ। বন্ধমুখ বায়ুশূন্য অন্ধকার গুহায়
আড়াই হাজার বছর তিনি ধ্যনস্থ ছিলেন। দেহ কঙ্কালসার। অথচ তাঁর অন্তশ্চেতনা লোপ
পায়নি। ভোজন তো দূরের কথা, গুহামুখ বহু কালের মৃত্তিকাগুল্মে আচ্ছাদিত থাকায়,
গুহার ভিতরে বায়ুপ্রবেশের পথ ছিল কিনা বলা মুশকিল। প্রসঙ্গ থেকে দূরে সরে
গিয়েছিলাম। এবার অহল্যার কথায় ফেরা যাক্। অহল্যার শাপমুক্তির উপায় ঐ তিন রামায়ণে
একই বলা হয়েছে। বাল্মীকি বলেছেনঃ
‘যদা ত্বেদং বনং ঘোরং রামো দশরথাত্মজঃ।
আগ মিষ্যতি দুর্ধস্তদা তদাপুতা ভবিষ্যামি।।’ - (বাল্মীকি রামায়ণ/
বালকাণ্ড, ৪৮ সর্গ, ৩৯ নং শ্লোক)
বঙ্গানুবাদ করে বলা যায়, দশরথপুত্র রামচন্দ্র যখন এই ভয়ঙ্কর
বনে আসবেন, তখন তুমি শাপমুক্ত হয়ে পবিত্র হবে। তুলসীদাসী রামায়ণে দেখি, মহর্ষি
বিশ্বামিত্র শ্রীরামকে বলছেনঃ ‘চরণকমলরজ চাহতি কৃপা করহ রঘুবীর।’ অর্থাৎ হে
রঘুবীর! আপনার চরণধূলি প্রার্থনা করছেন ঐ পাষাণ দেহধারী অহল্যা; আপনি ওর প্রতি
কৃপা করুন। [শ্রীরামচরিত মানস – বালকাণ্ড – পৃঃ ১৮১]
এরপর ‘পরসত পদপাবন সোক নসাবন প্রগট ভঙ্গ তপপুঞ্জ সহী’
শ্রীরামচন্দ্রের চরণ –স্পর্শ পাওয়ামাত্র পাষাণময়ী অহল্যা নড়ে উঠলেন, তাঁর অব্যক্ত
প্রাণ ব্যক্তভাব ধারণ করল। তিনি করজোড়ে শ্রীরামের সম্মুখে দণ্ডায়মান হলেন।
এবার কবি কৃত্তিবাস অহল্যা শাপমুক্তির কথা কিভাবে বর্ণনা
করেছেন, দেখে নেওয়া যাক্। অহল্যার কাতর প্রার্থনায় ঋষি গৌতম বললেনঃ-
‘জন্মিবেন যবে রাম দশরথের ঘরে।
বিশ্বামিত্র লয়ে যাবে যজ্ঞ রাখিবারে।।
তোমার মাথায় পদ দিবে নারায়ণ।
তখনি হইবা মুক্ত .........।।‘
(কৃত্তিবাসী রামায়ণে - পৃঃ ৬৫)
এ পর্যন্ত আলোচনায় জানা গেল, অহল্যা স্বয়ং ব্রহ্মার সৃষ্টি,
ত্রিলোকসুন্দরী, রূপে গুণে অতুলনীয়া অথচ শাপগ্রস্তা। কেন? এ প্রশ্নের উত্তর জানার
জন্য পিছন ফিরে তাকাতে হবে।
মহর্ষি বিশ্বামিত্র অযোধ্যাপতি দশরথের দুই পুত্র
রাম-লক্ষণকে নিয়ে রাক্ষস বধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন। ভয়ঙ্কর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে
পথ। পথে সিদ্ধাশ্রমে তাঁরা রাত্রি বাস করলেন। পরে ইক্ষাকু বংশের রাজা সুমতির বিশাল
নগরী অতিক্রম করে মিথিলার দিকে এগিয়ে চললেন। মিথিলার উপবনে একটি পরিত্যক্ত জীর্ণ,
জনপ্রাণীশূন্য আশ্রম দেখে রাজকুমারদ্বয় মহর্ষির কাছে ঐ আশ্রমের বৃত্তান্ত জানতে
চাইলে মহর্ষি তাঁদের ঋষি গৌতম ও তাঁর পত্নী অহল্যার কাহিনী শোনালেনঃ
“একদা ঋষি গৌতম তীর্থ স্নান সেরে, একহাতে কুশের গোছা,
অন্যহাতে যজ্ঞকাষ্ঠের বোঝা নিয়ে আশ্রমে ফিরছেন। তপজ্যোতিতে দেদীপ্যমান তাঁর
সর্বাঙ্গ। এদিকে দেবরাজ ইন্দ্র আশ্রম ফাঁকা পেয়ে গৌতম মুনির বেশ ধরে চুপিসারে
আশ্রমে প্রবেশ করলেন তাঁর আদিম বাসনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে। কৃতার্থ হয়ে দেবরাজ
বাইরের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই চমকে উঠলেন। একি! অপূর্ব জ্যোতিচ্ছটায় আশ্রমমুখী পথ
উদ্ভাসিত। সাক্ষাৎ অগ্নি যেন আশ্রমের দিকে এগিয়ে আসছে। দেবরাজের বুঝতে বাকি রইল
না, ঐ জ্যোতিঃপুঞ্জ ঋষি গৌতমের দেহোভিন্ন আলোকচ্ছটা। দ্রুতপদে পালাতে গিয়ে গৌতমের
সামনে পড়ে গেলেন। ঋষিবর ইন্দ্রের অপকীর্তি বুঝতে পেরে অভিশাপ দিলেন। পরে আশ্রমে
পৌঁছে স্বপত্নী অহল্যাকে অভিশাপ দিলেন। স্বীয় পত্নীকে পাপের দণ্ড দিয়ে, তার
মুক্তির উপায়ও বলে দিলেন। এরপর গৌতম ঋষি অহল্যাকে একা ফেলে রেখে আশ্রম ত্যাগ করে
দুশ্চর তপস্যার জন্য হিমালয়ে চলে গেলেন। সেই থেকে এই আশ্রম শূন্য পড়ে আছে। এখানেই
অহল্যা একান্ত নিরিবিলিতে মনুষ্য, মনুষ্যেতর প্রাণী, এমনকি দেবাসুরেরও
অলক্ষ্যে থেকে সম্পূর্ণ নির্বিঘ্নে সুকঠোর
তপশ্চর্যায় রত আছেন।”
এই আখ্যান শুনিয়ে ঋষি বিশ্বামিত্র শ্রীরামচন্দ্রকে বললেন,
“চলো বৎস, পুণ্যকর্মা মহর্ষি গৌতমের আশ্রমে গিয়ে দেবীরূপিণী মহীয়সী অহল্যাকে
উদ্ধার কর।” “তারয়ৈনাং মহাভাগামহল্যাং দেবরূপিণীম।” - (বাল্মীকি রামায়ণ/ বালকাণ্ড- ৪৯ সর্গ/ ১২)
বিশ্বামিত্রের কথায় শ্রীরাম, লক্ষণের সাথে ঋষিবরকে অনুসরণ
করে আশ্রমে প্রবেশ করলেন। স্বীয় তপস্যার তেজে জাজ্বল্যমান অহল্যাকে দেখলেন। তিনি তপোজ্যোতিঃপুঞ্জে
নিজেকে এমন ভাবে আচ্ছাদিত করে রেখেছিলেন যে, মানুষ তো দূরের কথা, দেবতা বা অসুরের
পক্ষেও ঐ জ্যোতিঃপুঞ্জ ভেদ করে তাঁর দর্শনলাভ অসম্ভব ছিল।
গৌতমমুনির শাপবশত শ্রীরামের দর্শন না হওয়া পর্যন্ত
ত্রিলোকের যে কোন প্রানীর পক্ষে অহল্যা দুর্নিরীক্ষ ছিলেন। শ্রীরামচন্দ্র আশ্রমে
পদার্পণ করা মাত্র তাঁর শাপান্ত হওয়ার ফলে তিনি সকলের দর্শনগোচর হলেন। এবার দাশরথি
ভাতৃদ্বয় অহল্যার চরণ বন্দনা করলেন। “রাগবৌ তু তদা তস্যাঃ পাদৌ জগৃহতুমুর্দা” - (বাল্মীকি রামায়ণ/
বালকাণ্ড- ৪৯ সর্গ/ ১৭)। অহল্যাও যথাবিধি তাঁদের আপ্যায়িত করলেন। রাম–লক্ষণ
দুই ভাই পরম তৃপ্তি সহকারে সেই আপ্যায়ন গ্রহণ করলেন। এই ঘটনায় দেবগন্ধর্ব ও
অপ্সরাকুল আনন্দিত হলেন। স্বর্গ থেকে দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি করলেন। গৌতমমুনির
নির্দেশে কঠোর তপশ্চর্যার বলে ও শ্রীরামচন্দ্রের দর্শনের ফলে অহল্যা তাঁর নিষ্পাপ
পূর্ব শরীর ফিরে পেলেন।
এই কাহিনী থেকে অহল্যা শাপগ্রস্ত কেন, তা জানা গেল। কিন্তু
এখানে একটা বিষয় বিচার্যঃ অহল্যা কি সত্যিই অপরাধী? অহল্যা তো দেবরাজ ইন্দ্রকর্তৃক
প্রতারিত। ইন্দ্র গৌতমমুনির ছদ্মবেশে অহল্যার সঙ্গ কামনা করেছিলেন। অহল্যা সেই
প্রস্তাবে রাজি হয়ে তো কোন অন্যায় করেনি।
কিন্তু আর একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, অহল্যা অপরাধিনী,
আত্মপ্রবঞ্চক। কেননা, অহল্যা ইন্দ্রকে গৌতমের ছদ্মবেশধারী বলে চিনতে পারলেও তাঁর
প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন স্রেফ কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে। যথা,
“মুনিবেষং সহস্রাক্ষং বিজ্ঞায় রঘুনন্দন।
মতিং চকার দুর্মেধা দেবরাজকুতুহল্যাৎ ।।”
-- (বাল্মীকি রামায়ণ/
বালকাণ্ড- ৪৮ সর্গ/ ১৯-২০)
পরের শ্লোকে অহল্যার দুর্মতিত্ব অ্যারো স্পষ্ট ভাবে ফুটে
উঠেছে, যেখানে মহর্ষি বাল্মিকি তাঁর মুখ দিয়ে বলাচ্ছেনঃ
“কৃতার্থাস্মি সুরশ্রেষ্ঠ গচ্ছ শীঘ্রমিতঃ প্রভো।
আত্মানং মাং চ সর্বথা রক্ষ গৌতমাৎ।।”
-অহল্যা যে দেবরাজকে চিনতে পেরেছিলেন, তার প্রমান নিজ মুখেই
দিয়েছেন ইন্দ্রকে সুরশ্রেষ্ঠ বলে সম্বোধন করে। তাঁর অপরাধের আরো স্পষ্ট প্রমাণ,
তিনি নিজ মুখেই বলেছেন, ‘আমি কৃতার্থ হয়েছি।’ তাঁর উক্তির মধ্যে কোন অনুশোচনার
প্রকাশ নেই। অতএব তিনি জেনেশুনে পাপ করেছেন। সামাজিক দৃষ্টিতে, সততা বা সতীত্বের
বিচারে যা গর্হিত অপরাধ। তাই প্রশ্ন ওঠে সেই বহু প্রচলিত শ্লোক নিয়ে, যথাঃ
‘অহল্যা, দ্রৌপদী,
কুন্তি, তারা মন্দোদরী তথা।
পঞ্চ কন্যাং
স্মরেন্নিত্যং মহাপাতক নাশনম্ ।।’
-যে পঞ্চকন্যার স্মরণ করলে মহাপাপের নাশ হয়, সেই পঞ্চকন্যার
নামের তালিকার আদিতে অহল্যার নাম রয়েছে। তার মানে, ঐ কন্যার মধ্যে অহল্যাই
শ্রেষ্ঠ। কিন্তু তা কি করে হয়?
অহল্যার সমগ্র জীবন পর্যালোচনা করে আমরা দেখেছি, কৌতূহলের
বশে অহল্যা যে পাপে লিপ্ত হয়েছিলেন, সে পাপ তিনি গোপন করার বা অস্বীকার করার কোন
চেষ্টা করেন নি। পতির অভিশাপেরও কোন প্রতিবাদ করেন নি। বরং স্বামীর নির্দেশ মেনে
নির্জন আশ্রমে বহু হাজার বছর ধরে শ্রীরামের চিন্তাই করেছেন। এ এক কঠোর তপশ্চর্যা ও
প্রায়শ্চিত্ত। প্রায়শ্চিত্তের দ্বারা পাপ খণ্ডন হয়, এ বিধান সকল শাস্ত্রেই আছে।
যথাঃ ‘প্রায়শ্চিত্তানি পাপক্ষয় সাধনানি চান্দ্রায়ণাদীনি’ – (বেদান্তসারঃ অধিকারি
নির্ণয়ঃ ১১)। অর্থাৎ পাপক্ষয় করার উপায় চন্দ্রায়ণব্রত ও অন্যান্য কৃচ্ছ্রসাধনমূলক
তপস্যা। অহল্যা সেই তপস্যায় সিদ্ধ হয়েছেন এবং তাঁর পূর্বকৃত পাপেরও বিনাশ হয়েছে।
প্রায়শ্চিত্তের আগুনে অহল্যার মনের কামাদি রিপু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তিনি এখন
শুচিশুদ্ধ। আরো বিচার্য, অহল্যা শুধু শারীরিক কৃচ্ছ্রসাধনাই করেননি, তার সাথে তিনি
ধ্যান-জপেও মগ্ন ছিলেন। যেহেতু তাঁর শাপমোচনের একমাত্র উপায় ছিল শ্রীরামের দর্শন ও
তাঁর আপ্যায়ন, তাই তিনি নিরন্তর রামনাম জপ ও ধ্যান করেছেন। যেহেতু তাঁর বায়ুমাত্র
আহার্য ছিল, তাই তাঁর ক্ষুৎপিপাসা বিবৃত্তির জন্য উদ্বেগ ছিল না। আবার আশ্রম
সর্বপ্রকার জীববর্জিত হওয়ায় তাঁর মনোযোগ খণ্ডিত হওয়ার কোন আশঙ্কা ছিল না। এভাবে
তাঁর সমগ্র চিত্তবৃত্তির নিরোধ হওয়ায় তিনি যোগযুক্ত হয়েছিলেন। পাতঞ্জল যোগশাস্ত্রে
আরো আছেঃ ‘তজ্জপস্তদর্থভাবনম্।’ –(রাজযোগ সমাধি পাদ-২৮) এই সুত্রে বলা হয়েছে,
ঈশ্বরের বাচক শব্দ ওঁকারের জপ ও তার অর্থ চিন্তন করলে মানুষের অন্তঃস্থিত
কুসংস্কারসমূহ সূক্ষ্ম হ’তে হ’তে ক্রমশ বিলীন হয়ে যায়, ওপর পক্ষে মনের গভীরতর
স্তরে চাপা পড়ে থাকা আধ্যাত্মিক সংস্কারগুলি ওপরের স্তরে ভেসে ওঠে। এতে মানুষের
অন্তর এত পবিত্র হয় যে, অন্তর্দৃষ্টি বিকশিত হওয়ার ফলে সে দেবত্বে উপনীত হয়। এখানে
উল্লেখ্য ওঁ শব্দ যেমন ঈশ্বরের বাচক, তেমনি ‘রাম’ শব্দও ঈশ্বরের বাচক। রাম নামে যে
পাপক্ষয় হয় তার প্রমান দস্যু রত্নাকরের গল্পেও পাওয়া যায়।
শ্রীরামের দর্শন পেয়ে অহল্যা তাঁর স্তুতি করলেনঃ
“ম্যায় নারি অপাবন প্রভু জগপাবন ...... রাজীবলোচন ভবভয়মোচন
পাহি পাহি সরলহিং আঈ।” – (রামচরিত মানস)
বাংলায় যার অর্থ হ’ল, হে প্রভু, আমি অপবিত্র নারী, আপনি
জগৎপাবন, ভবভয়হরণকারী।
কৃপা করে আমাকে
রক্ষা করুন, আমি আপনার শরণাগত।
আমরা জানি, শ্রীরাম শরণাগতবৎসল। শত্রু পক্ষ থেক আগত
শরণার্থী বিভীষণকে আশ্রয় দিতে তাঁর বন্ধুবর্গ বাধা দিলেও শ্রীরাম বলেছিলেনঃ
“সকৃদেব প্রপন্নায় তবাস্মীতি যাচতে।
অভয়ং সর্বভূতেভ্যো দদাম্যেতদ্ ব্রতং মম।”
–(বাল্মীকি রাঃ
যুদ্ধ কাঃ/ ১৮- সর্গ/৩৩)
অর্থাৎ একবার যে আমার শরণাগত হয়, সর্বপ্রাণীকুল থেকে অভয়
দান করাই আমার ব্রত।
অহল্যা যত গর্হিত পাপই করে থাকুন, পাপক্ষয় নিমিত্ত কোন
কৃচ্ছ্রসাধন না করলেও শ্রীরামের শরণাগত হওয়ার সাথে সাথেই তাঁর সমস্ত পাপ ধুয়ে মুছে
গেছে। শ্রীরামের দর্শন পেয়ে অহল্যা এত পুলকিত হয়েছেন যে, তাঁর পতির দেওয়া অভিশাপকে
আশীর্বাদ মনে হয়েছে। তিনি বললেনঃ
“মুনি শ্রাপ জো দীনহা অতি ভল কীনহা
পরম অনুগ্রহ ম্যায় মানা।
দেখেউঁ ভরি লোচন হরিভবমোচন...।।
বিনতী প্রভু মোরি ম্যায় মতি ভোরী নাত ন্ মাঙ্গউবর আনা।
পদকমল পরাগারস অনুরাগা মমমন মধুপ করে পানা।।”
–(রামচরিত
মানস/ বাল কাণ্ড/ ১৮১ পৃঃ)
এই কয়েকটি পদে অহল্যার ভক্তিরস যেন উপচে পড়েছে। অহল্যা
বলেছেন, গৌতমমুনি শাপ দিয়ে আমার উপকারই করেছেন। এ শাপের ফলে আমি দু’চোখ ভরে
ভববন্ধন মোচনকারী শ্রীরামের দর্শন সৌভাগ্য লাভ করলাম। তাই হে প্রভু, অন্য কোন বর
প্রার্থনা করি না – আমার শুধু এইটুকু প্রার্থনা যে, আমার মনভ্রমর যেন সর্বদা তোমার
চরণকমলের মধুপানে মত্ত থাকে।
এই কয়েকটি পদে তুলসীদাসজীর সুললিত ছন্দে অহল্যা হয়ে উঠেছেন
ভক্তির মূর্ত বিগ্রহ – প্রতি পদে যেন ভক্তিরস উপচে পড়ছে।
তুলসীদাসজী মূলত ভক্তকবি। তাই অহল্যাদেবীর ভক্তির আতিশয্য
তাঁকে আবেগাপ্লুত করে তুলেছে। এ কারণে তিনি অহল্যার পূর্বজীবনের দিকে তাকাননি।
অহল্যা শাপগ্রস্তা, একথার উল্লেখ করলেও কেন শাপগ্রস্তা, তা নিয়ে মাথা ঘামাননি।
বাঙালীকবি কৃত্তিবাস ও হিন্দীকবি তুলসীদাস, উভয়েই ভক্তিরসাশ্রিত কবি। উভয়ের
চিন্তাতেই বিষ্ণু অবতার শ্রীরামচন্দ্রের পক্ষে কোন অভিশপ্ত নারীর চরণবন্দনা
মর্যাদা হানিকর মনে হয়েছে। তাই ভক্তির আবেগে উভয়েই বাল্মীকির বিপরীত চিত্র
এঁকেছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন, অহল্যা প্রথমে শ্রীরাম-লক্ষণের পাদ বন্দনা করছেন। যথা,
কৃত্তিবাসে – ‘তোমার মাথায় পদ দিবে নারায়ণ......’ (কৃত্তিবাসী রামায়ণে - পৃঃ ৬৫)
আবার তুলসীদাস ঋষি বিশ্বামিত্রের মুখ দিয়ে বলিয়েছেনঃ “চরণ
কমলরজ চাহতি কৃপা করহু রঘুবীর।” অর্থাৎ অহল্যা তোমার চরণধূলি প্রার্থনা করছে, তুমি
কৃপা করে ওকে চরণধূলি দাও। বিশ্বামিত্রের নির্দেশে শ্রীরাম প্রস্তরীভূত অহল্যার
দেহে চরণ স্থাপন করা মাত্র তপোমূর্তি অহল্যা তাঁর সামনে করজোড়ে সত্যি সত্যিই উঠে
দাঁড়ালেন।
কিন্তু আদিকবি এ বিষয়ে কি বলেছেন, শ্রীরামচন্দ্রই আগে অহল্যার চরণ বন্দনা করেছেন। উপসংহারে বলতে
হয়, অহল্যা স্বয়ং ব্রহ্মার মানসকন্যা এবং তপঃসিদ্ধা। তাই তাঁর স্মরণে মহাপাপের নাশ
হওয়াই স্বাভাবিক।
* সমাপ্ত *