Thursday, 14 February 2013

সরস্বতী রহস্য

চরৈবেতি, বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনের সৌজন্যে---

সরস্বতী রহস্য


আজ আমরা জ্ঞান দেবী সরস্বতী মূর্তির আড়ম্বর পূর্ণ পূজায় যে স্ম্য ও অর্থ ব্যয় করি তা কি কোন তথাকথিত দেবী বিশেষ, না ঋষি কল্পিত কোন এক মহান তত্ব – জার বাস্তব ব্যাঞ্জনা আমাদের গৌরবময় অতীত সংস্কৃতিকে তুলে ধরে – এটা জানা একান্ত জরুরী। আজ আমাদের কৌতূহলী মনের একান্ত জিজ্ঞাসা শ্বেত শুভ্রা সরস্বতী বীনা হস্তে কেন ? কেন তিনি হংস সমন্বিতা ? তা সম্যকরূপে অবগত হতে না পারলে আমাদের পূজা সার্থক রূপ পায়না। তা কেবল ই হয়ে ওঠে আড়ম্বর সর্বস্ব – তাই ঘটেছে ও ঘটছে। আমাদের জীবনের গতি হবে জানার দিকে কোন কিছুতেই নির্বিচারে মানা নয় বরং তা সবিচারে জানা। প্রকৃত সত্য কে জানলে তা মানতে কারুরই আপত্তি থাকার কথা নয় – তা সে যে পন্থী বা ধর্মাম্বলীই হোক না কেন।

        “সরস্বতী” কথার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ – ‘সরস’ –এর সাথে বতুপ প্রত্যয় যোগে অ স্ত্রী লিঙ্গে ‘ঈ’ যোগ করে ‘সরস্বতী’ শব্দটি নিষ্পন্ন হয়েছে। ‘সরস’ কথার অর্থ রসাল বা সমৃদ্ধ, ক্ষমতা থাকা অর্থে বতুপ প্রত্যয়। তাহলে সরস্বতী কথার অর্থ দাঁড়ায় সমৃদ্ধ বা উন্নত করার ক্ষমতা যার আছে এমন কোন ব্যক্তি বিশেষ।

        প্রথম প্রথম বৈদিক ঋষিদের দৈনন্দিন জীবনে দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় ধরা পড়ে জলের সরস্বতী রূপ। কারণ কৃষি, শিল্প, এমনকি বাঁচার যে কোন তাগিদেই জলের একান্ত প্রয়োজন। জল যেন মাতৃস্বরূপা, যার পবিত্র স্পর্শে জীবকুল হচ্ছে নিয়ত লালিত-পালিত। তাইতো ঋষিগন হিমালয় জাত সে যুগের শ্রেষ্ঠ স্রোতস্বিনীর নামকরণ করেছিলেন সরস্বতী, যা কালে প্রাকৃতিক বা মনুষ্য সৃষ্ট কারনে বিলুপ্ত। পরে পরে অভিজ্ঞতা ও মনীষা যখন আরো উন্নত ও পরিবর্ধিত হতে শুরু করল তখন বিচক্ষনেরা খুঁজে পেলেন প্রকৃত সরস্বতীকে আর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা জাত কল্পনায় রূপ দিলেন এক বিষয়কর মূর্তিরূপ মানচিত্রকে।

        জ্ঞান মানুষের জীবনকে সমৃদ্ধ করে, সমস্ত রকম প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সাহায্য করে, সমস্ত সমস্যার সমাধান’ই হচ্ছে আমাদের অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান। আমাদের এই মরুভূমির মতো জীবন তাই সুখে, শান্তিতে ও জ্ঞানের ঐশ্বর্যে ভরে ওঠে। সেজন্যই জ্ঞানদেবী সরস্বতী শ্বেতশুভ্রা – শ্বেতবসনা।

হংস-ই একমাত্র প্রানী যারা দুধ ও জলের মধ্যে শুধুমাত্র দুধের ভাগটা টেনে নিতে পারে, এবং এরা মাটি, বাতাস, জল সর্বত্র অবাধ বিচরন করতে পারে। জ্ঞানীই একমাত্র সব জায়গায় গ্রহণযোগ্য ব্যাক্তি এবং ভাল-মন্দ, সৎ-অসৎ, গুন-দোষ আলাদা করতে পারে তাই সরস্বতীর মূর্তির সাথে জন্স থাকে।

        পদ্ম ফুল জলেই স্থিতি অথচ জল ধারন করতে পারেনা। একই বৃন্তে গাথা শত পাপড়ির ন্যায় সংসার আবর্তে থেকে জ্ঞানীর বুদ্ধিদীপ্ত মন বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শত চিন্তা ভাবনা একত্রিত করে অনায়াসে আয়ত্ত করতে পারে।

        এখানে বীনা কোন বাদ্যযন্ত্র নয়। ইহা দেহরূপ বীনা যন্ত্র। ভারতীয় শাস্ত্র মতে যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তাই আছে এই দেহভান্ডে। বীনা যন্ত্রের সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-র ন্যায় মনের একগ্রতায় ঝংকৃত করে তুলতে হবে দেহস্থিত কুলকুণ্ডলিনী শক্তিকে ষটচক্ররূপ মূলাধার (গুহ্যদ্বারে নিকটস্থ গ্রন্থি), স্বাধিষ্ঠান (লিঙ্গ দ্বার স্থিত গ্রন্থি), মণিপুর (নাভি মণ্ডলস্থিত গ্রন্থি), অনাহত (বক্ষঃস্থলস্থিত গ্রন্থি), বিশুদ্ধ (কন্ঠনালিস্থিত গ্রন্থি) ও আজ্ঞাচক্র (ভ্রু যুগলের মধ্য স্থিত গ্রন্থি) ভেদ করে সহস্রারে (মস্তিস্ক স্থিত গ্রন্থি) উত্তরনের এক মহাসুর।

সরস্বতী মূর্তির এই ব্যাখা কবিতার ছন্দে ক্ত সাবলীল ও সহজ- সরল তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে তা বাঁকুড়া জেলার এক অপরিচিত শ্রদ্ধেয় কবি শ্রী অজিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় –এর নাম উল্লেখ করতেই হয়। কবিতাটি উদ্ধৃত করা হলঃ-

ঐ যে সরস্বতী                 ঐ যে জ্ঞানদেবী
কেন শ্বেতশুভ্র ?               কেন হাতে বীনা ?
কেন যে হংস ?                পদ্ম কেন ঐ ?
পুজো করি মোরা জানিনা।
জ্ঞান ই সরস করে    জীবন মরু
ফুলে-ফলে ভরে ওঠে জ্ঞানের তরু,
খেই হারা প্রশ্নের              আলোসম সমাধান, তাই
জ্ঞানদেবী শ্বেতবসনা।
মাটি জল কিংবা               সুদূর আকাশে
ঐ যে হংস দেখি,
যে দুধটুকু নিয়েনেবে অপরূপ সৃষ্টি
জলটুকু পাত্রেই রাখি।
জলেতে থেকেও              ওর গায়ে জল নেই
একই বৃন্তে গাঁথা             ঐ শতদল
একটি মনের সহস্র চিন্তা (তাই)
সপ্তসুরের দেহ বীনা ।।